ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এসএম সফির ক্যামেরায় এই আলোকচিত্রের ইতিহাস 

মোহাম্মদ আসাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৪১, ২৫ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এসএম সফির ক্যামেরায় এই আলোকচিত্রের ইতিহাস 

নয় মাস যুদ্ধের পর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বিজয়ের আনন্দ, উল্লাস ফিরে ফিরে এলেও মুছে যায়নি একাত্তরের ক্ষতচিহ্নগুলো। দেশ জয়ের ভয়াবহ সেই ক্ষত বারবার আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে আলোকচিত্রের মাধ্যমে। একাত্তরের সেই ভয়াবহ ঘটনার আলোকচিত্রের মধ্যে আছে রিকশায় পরে থাকা বাঙালির লাশ, বধ্যভূমিতে পরে থাকা বুদ্ধিজীবিদের ক্ষতবিক্ষত দেহ, শকুন খাচ্ছে মৃতের দেহসহ আরো অনেক ছবি। এই নিবন্ধে রিকশায় পরে থাকা বাঙালির লাশের ছবিটিতেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

এটি একাত্তরের গণহত্যার অন্যতম আইকনিক ছবি। ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ’ লিখে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখুন শত শত ছবির ভিড়ে ছবিটি পেয়ে যাবেন। পাবেন গণহত্যা ও একাত্তরের অনেক লেখার সঙ্গে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী অস্ত্র হাতে রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকাবাসীর উপর। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো রক্তে রঞ্জিত হয়। বাঙালি পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে হামলা চালায়। জ্বালিয়ে দেয় একের পর এক বস্তি ও আবাসিক এলাকা। গুলি করে হত্যা করে অসংখ্যা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বাঙালি পুলিশ এবং সাধারণ বাঙালিকে। সে রাতের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের আইকনিক ছবি হিসেবে ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে একাত্তরসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লেখা, বই ও প্রকাশনায়। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি কে তুলেছেন বা কোথা থেকে তোলা হয়েছে সে তথ্য অনেকেরই অজানা।

পুরনো বইপত্র ঘাটতে গিয়ে ক্যাটালগ টাইপের একটি আলোকচিত্রের বই নজরে পড়ে। ‘আলোকচিত্রে একাত্তর’। ফটোগ্রাফার এস এম সফি। সেই বইয়ে রয়েছে ছবির ইতিহাস। এস এম সফি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হানাদারের  আক্রমণ এবং তাদের নিষ্ঠুর বর্বরতার ছবি তুলেছিলেন। তিনি বেশির ভাগ ছবিই তুলেছিলেন যশোরের বিভিন্ন এলাকায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ৩ মার্চ যশোর টিএন্ডটি অফিসের সামনে পাকিস্তানি হানাদারের হাতে প্রথম শহীদ হন গৃহবধূ চারুবালা। তার মৃত দেহ নিয়ে মুক্তিকামী মানুষ মিছিল করে। সেই ছবি ধারণ করেছিলেন তিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আইকনিক রিকশায় পরে থাকা লাশের ছবিটিও একাত্তরের মার্চ মাসেই তোলা। তাঁর ছেলে আলোকচিত্রী সানোয়ার আলম শানু বলেন ‘ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি আমার বাবা তুলেছিলেন ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। ওই দিন পাকিস্তানি আর্মি যশোর নিউমার্কেট এলাকায় সাধারণ বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেখান থেকেই এই ছবিটি তোলা হয়। এই এলাকার নাম এখন উপশহর।’ 

সেই সময় পৃথিবীর অনেক পত্রিকায় ছবিটি ছাপা হয়েছে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, একাত্তরের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ এলাকা যশোরে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়েছিল সবার আগে। যুদ্ধ শেষও হয়েছে আগে;   ৬ ডিসেম্বর যশোর হানাদার মুক্ত হয়।

১৯ মার্চের পর ছবিটি কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের অফিসে গিয়ে পৌঁছতে কয়েকদিন সময় লাগে। ততদিনে ২৫ মার্চের ভয়াবহ হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের খবর পৃথিবী জেনে গেছে। যে কারণে ছবিটি ২৫ মার্চ কালরাত্রির ছবি হিসেবেই পরিচিতি পায়। এই ছবি নিয়ে অনেকের ভ্রান্ত ধারণা আছে। একজন সিনিয়র ফটোসাংবাদিক আমাকে জানিয়েছিলেন- এটা অবাঙালিদের ছবি। যদিও এর স্বপক্ষে তিনি যুক্তি দিতে পারেননি। অন্য কারো কাছে এর উত্তরও পাইনি। একটু তথ্যানুসন্ধান করতেই জানা গেল, মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পরিচালক এম আর আখতার মুকুলের লেখা ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইয়ে একটা স্মৃতিচারণ থেকেই হয়তো এই ভুল ধারণার সৃষ্টি। যদিও লেখক স্পষ্ট করেই বলেছেন, পাকিস্তানি হানাদাররা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করেছে। লেখাটি মনোযোগ দিয়ে না পড়ার কারণে এমন ভ্রম হয়ে থাকতে পারে। পাঠকের জন্য বইয়ের লেখাটুকু হুবহু তুলে দিলাম:

‘‘তারিখটা মনে না থাকলেও মাসটা ছিল একাত্তরের মে মাস। বিকালের দিকে এক নম্বর চৌরঙ্গী টেরাসে অজিত দাশ-এর ইউপিআই অফিসে বসে কাজ করছিলাম। এমন সময় হাল্কা রঙের গগলস পরিহিত লম্বা-চওড়া এক অবাংগালী ভদ্রলোক এসে প্রবেশ করলেন। হাতে পুরনো এক কপি অমৃতবাজার পত্রিকা। ভদ্রলোক কাগজটা অজিতদার দিকে এগিয়ে দিয়ে ভাঙ্গা বাংলায় বললেন, ‘এই ফটো কি আপনারা পাঠিয়েছেন? দু’জনে হুমরি খেয়ে ফটোটা দেখলাম। নিচে ইউপিআই-এর ক্রেডিট লাইন দেয়া আছে। অজিতদা জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ আমরাই পঠিয়েছি। তা হয়েছে কি?’ একাত্তরে বিশে^র বহু পত্র-পত্রিকায় এই ফটো ছাপা হয়েছে। এতে যশোরে পাকিস্তানী সৈন্যদের হামলায় নিহত জনা কয়েকের লাশ একটা রিকসার উপরে স্তূপিকৃত রয়েছে দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোক ঠান্ডাভাবে বললেন, ‘এই ফটোর একটা কপি আমার দরকার। পয়সা-কড়ি খরচ করতে রজি আছি।’ ভদ্রলোকের আগ্রহ দেখে কৌতূহল বেড়ে গেলো। তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘এত ফটো থাকতে এই বিশেষ ফটোর জন্য আপনার আগ্রহ কেন?’ জবাব এলো, ‘সে অনেক কথা। আপনাদের সময় থাকলে বলতে পারি।’ এরপর অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ফটোটা হাতে নিয়ে রিকসার লাশগুলোর একটা প্রৌঢ় শ্মশ্রুমন্ডিত লাশের উপর আংগুল রেখে বললেন, ‘ইনিই হচ্ছেন আমার জন্মদাতা।’ কথা শুনে চমকে উঠলাম! তাহলে কি লাশগুলো অবাংগালীর? ভদ্রলোক আমার চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনাদের ফটো ও ক্যাপসান ঠিকই আছে। আজ থেকে ২৫/২৬ বছর আগেকার কথা। আব্বা আম্মা আর আমরা সব ভাই-বোন একই সংগে এই কলকাতা শহরে খুব হৈ চৈ এর মধ্যে ছিলাম। ধরমতলায় আব্বার কাপড়ের ব্যবসা তখন জমজমাট। এই সময় আব্বা এক বাংগালী মুসলমান মহিলার প্রেমে পড়লেন। আম্মা বহু চেষ্টা করেও আব্বাকে এই সর্বনাশা পথ থেকে ফেরাতে পারলেন না। এরপর দেশ বিভাগ (১৯৪৭ সাল)। আমরা ঘুণাক্ষরে জানতে পারিনি যে, আব্বা ওই মহিলাকে নিকা করেছেন। সবার অলক্ষ্যে আব্বা যশোরের এক হিন্দু ভদ্রলোকের বসতবাটির সংগে কাপড়ের দোকানের বদলা-বদলি করে বাকী সম্পত্তি আমাদের জন্য রেখে নতুন বউ নিয়ে দিব্যি পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন। এরপর আর আব্বার সংগে আমাদের দেখা হয়নি। উনিতো বাংগালীই হয়ে গিয়েছিলেন। আম্মাও কোনদিন আব্বার কথা আলোচনা করেনি। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংগালী হিসেবেই ওনাকে হত্যা করেছে। এখন আব্বার স্মৃতি রাখার জন্যই এই ফটোটা দরকার।’  কথাগুলো বলে ভদ্রলোক হু হু করে কেঁদে উঠলেন।’’

লোকটি ১৯৪৭ সালে বাঙালি নারীকে বিয়ে করে সব ফেলে চলে আসে যশোর। ভালোবাসার টানে স্ত্রী-সন্তান সবই ফেলে আসে কলকাতায়। তারপর দুই যুগ, ২৪ বছর পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সেই লোকের ইতিহাস খুঁজলে হয়তো ভালোবাসার ভয়ানক এক গল্প পাওয়া যাবে। তখন হয়তো ধনী সেই ব্যক্তিটি ভালোবাসার টানে সর্বশান্ত হয়েছেন। হয়েছেন বাঙালিও। ব্যবসাপাতি আগেই বদল করে এসেছেন। সম্ভবত এই সময় তাকে বাঁচতে হয়েছিল রিকশা চালিয়ে উপার্জনের ওপর। দুই যুগ পর সে তখন পুরপুরি বাঙালি। পাকিস্তনি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে অন্যান্যদের সঙ্গে তাকেও মরতে হয়েছে।

শুধু এই ছবিটিই নয়, একাত্তরে অনেক গুরত্বপূর্ণ ছবি তুলেছেন এস এম সফি। আমার মনে হয়, পাকিস্তানি হানাদারদের সরাসরি আত্রমণের ছবি একমাত্র তিনিই তুলতে পেরেছিলেন। বন্দুকের বাট দিয়ে এক বাঙালিকে আক্রমণ করছে এমন ছবি তাঁর বইয়ে দেখেছি। তাঁর আরেকটি আইকনিক ছবি দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা ভেজা কাপড়ে এক গ্রেনেডের টুকরো নিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ করার উপায় নাই। দুই নারীর একজন ছিলেন এস এম সফির স্ত্রী জামিলা খাতুন। তিনিও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন স্বামীর সঙ্গে। সেই সময়ে তিনি তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছবিও। এস এম সফির বড় গুণ তিনি নিয়মিত ছবিগুলো কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের অফিসে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। যে কারণে তাঁর ছবি ছড়িয়ে গিয়েছিল পৃথিবীতে।

মুক্তিযোদ্ধা ও আলোকচিত্র সাংবাদিক এস এম সফি ১৯৩৪ সালের ১০ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ দলিল উদ্দিন, মায়ের নাম আকলিমুন্নেসা। সফির শৈশব কেটেছে ভারতের দার্জিলিংয়ে। জলপাইগুড়ির একটি স্টুডিওতে চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবনের শুরু। সেখানেই ক্যামেরায় হাতেখড়ি। কিশোর বয়সে দার্জিলিংয়ের অনেক অপরূপ দৃশ্য ধারণ করেছিলন তিনি। ১৯৬২ সালে যশোরে চলে আসেন। পরের বছর তিনি যশোর শহরে ‘ফটো ফোকাস’ নামে স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। একাত্তরে এক হাতে অস্ত্র, আরেক হাতে ক্যামেরা নিয়ে ঝাপিয়ে পরেছিলেন গেরিলা যুদ্ধে। স্ত্রী ছিলেন রণাঙ্গনের সঙ্গী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় তাঁর পৈতৃক পাকাবাড়ি হানাদাররা মর্টার চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এই আলোকচিত্রী সাংবাদিক একাত্তরের নয় মাস হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের ছবি তুলেছেন জীবন বাজি রেখে। তাঁর ছবি ছাপা হয়েছে দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায়। এই আলোকচিত্রী ১৯৯৭ সালের ১০ আগস্ট ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। 

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়