ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

স্মৃতিগদ্য

ভয় নেই নিমাইদা এসে গেছেন

রেজাউদ্দিন স্টালিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ২৬ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ভয় নেই নিমাইদা এসে গেছেন

তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আকাশে। অর্থাৎ আকাশ পথে। ঢাকা থেকে কলকাতা যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় সরকারি প্রতিনিধি হয়ে। আমার পাশের সিটে তিনি। সাদা মেঘ চুল। মাঝারি গড়ন। চোখের উজ্জ্বলতা বয়স ঢেকে দিয়েছে। দেখলে শরৎচন্দ্র বলে ভুল করতে পারেন যে কেউ! আমি চিনেছিলাম। বইয়ের ভেতরে তাঁর ছবি দেখেছি বহুবার। সালাম দিলাম- আমি রেজাউদ্দিন স্টালিন; বাংলাদেশের। কলকাতা বইমেলায় যোগ দিতে যাচ্ছি। আপনার একজন পাঠক।

তিনি আগ্রহভরা হাসি হাসলেন। বিমানবালারা তাকে চেনেন। মাঝে মাঝে এসে পানি আর নাস্তা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তিনি শুধু পানি নিলেন। আমার দেশের বাড়ি যশোর জেনে তিনি নড়েচড়ে বসলেন। ভারি চশমা খুলে মুছে নিলেন। দেখলেন আমাকে। বললেন, তোমার গোঁফ তো স্টালিনের মতো- হাসলেন আন্তরিক। যশোরে আমার কৈশোরের অনেক স্মৃতি। যশোর আমার হৃদয়ে আছে। তুমি আমার আত্মীয় হয়ে গেলে। যশোরের যে ফখরে আলম- তাকে চেনো?

আমি বললাম, হ্যাঁ, সাংবাদিকতা করে এবং কবিতাও লেখে।

তিনি বললেন, ও আমার খুব প্রিয়। আমার যত্নআত্তি করে যশোর গেলে। তুমি কোথায় আছো?

নজরুল ইনস্টিটিউটে।

এটা কোথায়?

ঢাকার ধানমন্ডিতে।

আমি ধানমন্ডি গিয়েছি কয়েকবার।

জিজ্ঞাসা করলাম, বাংলাদেশের লেখা পড়েন?

হ্যাঁ, পড়ি। তোমাদের ইলিয়াসের লেখা ভালো লাগে। হাসান আজিজুল হকও ভালো লেখেন। ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে। তুমি ভেবেছো আমি কবিতা পড়ি না- পড়ি। তোমার কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় পড়েছি। আমি কবিতা পড়ি বেশি।

আমি বললাম, দাদা, নতুন কোনো বই কি এবার বইমেলায় আসবে? বললেন, না। পুরোনো লেখাগুলো আবার ছাপা হবে।

অনেক সাহস নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, একটা কথা বলতে পারি?

আরে বলো!

‘দেশ’ পত্রিকায় আপনার উপন্যাস দেখি না।

তিনি হাসলেন চমৎকার। একটা গভীর ব্যক্তিত্বের রেখা চোখের নিচে জেগে উঠলো। ‘দেশ’ পত্রিকা সিরিয়াস পাঠকদের। আমি সরল-সহজ পাঠকদের জন্য লিখি। যদি ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখি লেখাটা পাঠক আগেই পড়ে ফেলবে। বই বেরুলে কিনবে কেন? সুতরাং প্রকাশককে এই সুযোগটা দিই। জেটএয়ার মনে হয় ২৫ মিনিটেই কলকাতা নামবে।

হ্যাঁ দাদা।

ভ্রমণ প্রায় শেষ হয়ে এলো। তিনি আবার একটু জল চাইলেন। বিমানবালা এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে গ্লাস দিলো। জল পান শেষে বললেন, তোমাদের কাছে আমি জনপ্রিয় কিনা জানি না— তবে এদের কাছে পৌঁছেছি অনেক আগেই।

কিছু তথ্য নিতে নান্টু রায়কে ফোন করেছিলাম। নান্টুদা বললেন, আমার সঙ্গে তাঁর (নিমাই ভট্টাচার্য) পরিচয় ছিলো না। ‘ভারত বিচিত্রা’তে কখনো তিনি লেখেননি। তবে একটা গল্প আছে। দিল্লী এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদের। তিনি বললেন, আমি অমুক। মকসুদ ভাই তেমন আগ্রহ প্রকাশ না করায় তিনি পুনরায় বললেন, আপনি আমাকে চিনলেন না, তবে আপনার স্ত্রী নিশ্চয় আমাকে চেনেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ বিস্ময়ের সাথে বয়স্ক শুভ্র কেশ ব্যক্তিত্ববান মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ।

হ্যাঁ, অনেকক্ষণ বিমানে বসতে এই বয়সে ভালো লাগে না স্টালিন! চলো নামি। তুমি কোথায় উঠবে?

মার্কুইজ স্ট্রিটে। হোটেল সম্রাট।

বাহ্‌! তুমিও সম্রাট হয়ে যাবে। যাও দেখা হবে।

সেই প্রথম দেখা। এরপর আরো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। কলকাতা পুস্তকমেলায়। কখনো গিল্ডের অফিসে, কখনো UBI অডিটোরিয়ামে। দেখেছি জ্যেষ্ঠ, তরুণ নির্বিশেষে তাকে নমস্কার করছে। কেউ পা ছুঁয়ে প্রণাম জানাচ্ছে। একটু অভিজাত বয়স্ক ভদ্রমহিলাগণ ঘিরে রাখছেন। ওর মধ্যে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তিনি একবার এলেন বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে। আরো দু’বছর পরের কথা। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের স্টলে আমাদের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করলেন,  এবার স্টালিন আসেনি? কর্মীবন্ধুটি দেখিয়ে দিলেন- ঐ যে। আমি দেখেছিলাম ঢোকার সময়। এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলাম। বললেন, কিছুদিন আগে যশোর গিয়েছিলাম। ফখরের সাথে দেখা হয়েছিলো। ও তো বেশি অসুস্থ!

বললাম, আমি ঠিক জানি না দাদা। ঐবার মেলার শেষ দিন তিনি এসেছিলেন। আমি বরাবর তাকে দেখলেই বলতাম, দাদা আপনার চুলগুলো এতো সুন্দর! আপনি চুলে কি দেন?

তিনি বলতেন, মাঝে মাঝে শ্যাম্পট্যাম্পু দেই। ও চুল নিয়ে কখনো ভাবিনি।

কফি খাবেন?

আনো। আমাদের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের কর্নারে বসে তিনি অন্যমনস্ক। কী ভাবছিলেন জানি না। বললেন, দেশভাগ অনেক ক্ষতি করেছে বুঝলে! আমরা দুটো দেশ হয়ে গেলাম। বাংলা ভাষাভাষীদের একটা দেশ হলে ভালো হতো।

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। তিনি বললেন, তোমাদের এম.আর. আখতার মুকুলের সঙ্গে আমার খাতির ছিলো। বড় মজার লোক!

কফি শেষে উঠলেন। এরই মধ্যে তিনি দু’একবার সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ব প্রকাশ করলেন। আমি বললাম, দাদা আমি আপনার একটা ইন্টারভিউ করতে চাই। বললেন, এবার না। আগামীবার যদি আসো-আগে থেকে বলবে। টেপ রেকর্ডার থাকলে নিয়ে এসো।

আচ্ছা।

তিনি উঠে গিল্ডের দিকে রওনা দিলেন। পেছনে কয়েকজন ভক্ত হাঁটতে লাগলো। মনে পড়লো তাঁর সঙ্গে তো মেম সাহেবের থাকার কথা। কিন্তু কেন থাকবে? তিনি তো শ্রেণী আন্দোলনে বস্তুবাদী চিন্তাকে অত্যন্ত সঙ্গোপনে সমর্থন করেছিলেন। তার নায়িকার ভাই নকশাল আন্দোলনে নিখোঁজ হলে, নায়িকা ভাইয়ের খোঁজে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাকই তো মেমসাহেব।

যে ক’টা বইয়ের নাম কৈশোরে শুনেছি; বাড়িতে দেখেছি, পড়েছি তার মধ্যে ‘মেমসাহেব’, ‘দৃষ্টিপাত’, ‘বন্ধন’ কি আনন্দ আর উৎসুক্য নিয়ে পড়েছি! একটু বড় হয়ে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’।

বইমেলার শেষ দিন। সমাপ্তি ঘোষণা হবে। মাঘের শীত আমার পিঠ কামড়ে ধরেছে। সল্টলেকের ফাঁকা মাঠের মাঝখানে মঞ্চ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাত ধরে তাঁকে মঞ্চে নিয়ে এলেন সম্মানের সঙ্গে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, আজ সমাপ্তি ঘোষণা করবেন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক- আমাদের সকলের নিমাইদা- নিমাই ভট্টাচার্য।

বিপুল করতালিতে ফেটে পড়ল সভাস্থল। আমি ভাবলাম শিশুর মতো সরল এই মানুষটি মঞ্চে কি সপ্রতিভ, ব্যক্তিত্ববান। একটু গর্ব হলো তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ আছে বলে।

নিমাই ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রথম দেখা আকাশপথে। গতকাল তিনি আকাশপথে যাত্রা করেছেন অনন্তে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়তো স্বর্গের বইমেলায় অপেক্ষা করছেন আমাদের অতি প্রিয় নিমাইদাকে বরণ করে নিতে। তিনি হয়তো নিমাইদাকে মঞ্চে তুলে স্বর্গবাসীদের সামনে ঘোষণা করবেন- আর ভয় নেই নিমাইদা এসে গেছেন।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়