ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সমাজ বদলের স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল: আহমদ রফিক

হারুন পাশা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:০৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
সমাজ বদলের স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল: আহমদ রফিক

আহমদ রফিক মূলত প্রাবন্ধিক। রবীন্দ্রজীবন এবং সাহিত্য-সৃষ্টি নিয়ে রয়েছে তাঁর ভিন্নমাত্রিক মূল্যায়ন। কলামিস্ট হিসেবেও তিনি রেখেছেন সমকালের স্বাক্ষর। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলনে রেখেছেন সংগঠকের অনন্য ভূমিকা। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্টের তিনি প্রতিষ্ঠাতা, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জীবন সদস্য। বিবিধ পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বর্ণপদকে ভূষিত এই ব্যক্তিত্বের আজ জন্মদিন। দিনটি উপলক্ষ্যে সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছাসহ তাঁর এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক হারুন পাশা।

হারুন পাশা: পা পড়ল ৯১ বছরে। শুভ জন্মদিন। জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে কোনো অতৃপ্তির কথা কি মনে পড়ে?
আহমদ রফিক: এ প্রশ্নের জবাবে আমার একজন প্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের চিঠির ভাষ্যে বলি: ‘দীর্ঘজীবনের বিড়ম্বনা নিয়ে বেঁচে আছি।’ তার বিড়ম্বনা ছিল শারীরিক। কিন্তু আমার বিড়ম্বনা জাগতিক এবং পূর্বাপর। আমার জীবনটা এক ধরনের বহুমাত্রিক লড়াই। স্বভাবতই ‘অতৃপ্তি’ থাকবে। তবে সেটা ব্যক্তি প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নয়। সেটা মূলত আদর্শিক। সমাজ বদলের স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল। বাকি অতৃপ্তি লেখা নিয়ে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখা এখনও হয়ে ওঠেনি; আদৌও হবে কিনা জানি না।

হারুন পাশা: লেখালেখির প্রসঙ্গ যখন এলো তখন এর শুরুটা জানতে চাই।
আহমদ রফিক: লেখালেখির শুরু স্কুল জীবনে; সে তো কাঁচা লেখা। এমনকি কলেজ জীবনের শুরুতে লেখা কবিতা ও প্রবন্ধ (যেমন সুকান্ত’র কবিতা বিষয়ক লেখা প্রবন্ধ, ১৯৪৮) পরিণত বয়সের বিচারে আধপাকা বলে মনে হয়েছে মূলত রোমান্টিক আবেগের কারণে। সেসব রক্ষিত হয়নি। রক্ষণযোগ্য লেখা ১৯৪৪ থেকে শুরু বলেই আমি মনে করি। যেগুলো পরিমার্জিত হয়ে গ্রন্থবদ্ধ ও প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৮ সালের শুরুতে। সেই প্রথম বইটির নাম ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’। এখানে সাহিত্য-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন মার্ক্সবাদী নন্দনতাত্ত্বিক ধারায়।

হারুন পাশা: ১৯৫৮ সালের পর রাজনীতি থেকে সরে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। এই সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল বলে মনে করেন?
আহমদ রফিক: লেখা তথা সাহিত্যকর্মকে অর্থনৈতিক পেশা নয়, সাংস্কৃতিক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম রাজনীতির বিপরীতে। সেটা ঠিকই ছিল, এখনও আছে- এটা জীবিকার পাশাপাশি দ্বিতীয় পেশা। আর এখন তো এটা সার্বক্ষণিক। পড়া ও লেখাই এখন একমাত্র কাজ।

হারুন পাশা: মার্ক্সবাদে আগ্রহ কখন প্রবল হলো?
আহমদ রফিক: রাজনীতির শুরুটা ব্রিটিশ ভারতে চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে। স্বভাবতই পরাধীন দেশে স্বাধীনতা অর্জনের রাজনীতি অগ্রাধিকার পেয়েছে। এ রাজনৈতিক যাত্রায় কাজী নজরুল ইসলাম ও সুভাষচন্দ্র বসু প্রধান সঙ্গী। মার্ক্সবাদে আগ্রহ ও মার্ক্সবাদী রাজনীতি ও সাহিত্যপাঠ শুরু ১৯৪৮ থেকে। এর পেছনে উৎসাহ-আগ্রহ জুগিয়েছিলেন আমার এক অগ্রজ সেলিমদা, পোশাকী নাম এ. কে. এন আহমদ। এ চর্চা মননে-সৃজনে ও বাস্তবে প্রবলতা পায় ঢাকায় এসে কলেজ জীবনে; ধরা যেতে পারে ১৯৫০ থেকে। প্রগতিবাদী বিশ্বসাহিত্য পাঠের সূচনা তখন থেকে মূলত পেঙ্গুইন, পেলিকানের পেপারব্যাক বইগুলোর কল্যাণে। সেইসঙ্গে মোটা মলাটের ভারি বই পাঠ। কারণ একটাই- সমাজ বদলের স্বপ্ন। তবে হ্যাঁ, পাকিস্তানি আমলে কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণীর বাংলা ভাষা ও বাঙালি বিরোধিতা ষাটের দশকে আমাকে বাঙালি জাতিসত্তার মুক্ত বিকাশে প্রাণিত করে এবং তা বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রভাবে। এর প্রমাণ ধরা হয়েছে স্বদেশের মাটি, মানুষ ও প্রাকৃত সৌন্দর্যের পটভূমিতে লেখা কবিতায় (গ্রন্থ-বাউল মাটিতে মন) এবং বাঙালির শিল্পোদ্যোগে। এ পর্বে রাজনৈতিক দিক থেকে দুই ধারার মিশ্র যাত্রা।
 
হারুন পাশা: আপনি ভাষা আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। কীভাবে সেটি সম্ভব হয়েছিল, সংক্ষেপে যদি বলতেন।
আহমদ রফিক: ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ১৯৪৮-এর মার্চে মুন্সীগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজে পড়ার সময় মিছিলে-শ্লোগানে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫০-এ ঢাকায় মূলনীতি কমিটির উর্দু রাষ্ট্রভাষা সুপারিশসহ অন্যান্য অগণতান্ত্রিক ধারার বিরুদ্ধে সূচিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ। যেখানে ছিল রাজনীতিকদের প্রাধান্য। তাতে রাজনীতিমনস্ক ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতাও কম ছিল না। মনে আছে, এ উপলক্ষে আতাউর রহমান খান প্রমুখ রাজনীতিকদের সঙ্গে পুরনো ঢাকার রাজপথে মিছিলে হেঁটেছি, বার-লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত থেকেছি।
এরপর তো ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে সর্বাত্মক সংশ্লিষ্টতা যা আমাকে ভাসিয়ে নিয়েছিল। সেই ধারায় ৫ মার্চ পর্যন্ত নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম। ‘একুশে’ আমার জীবনে বড় একটি জায়গা দখল করে নেয়। জানি না, কী কারণে কৈশোর থেকে সুস্থ রাজনীতি ও সাহিত্য আমার জীবনে সর্বাধিক প্রাধান্য এবং গুরুত্ব পেয়ে আসছে। সে প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে। তবে এখন তা তাত্ত্বিক ধারায়। মূলত বয়সের কারণে।

হারুন পাশা: আন্দোলন পরবর্তী আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।    
আহমদ রফিক: মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি সত্ত্বেও কেরিয়ার গড়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতি। সম্ভবত এ ধারায় প্রবল মগ্নতার কারণে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পূর্ববঙ্গে ৯২-ক ধারায় কেন্দ্রীয় শাসন জারি (ইস্কান্দার মীর্জার গভর্নরি শাসন), ব্যাপক গ্রেফতার আমার ছাত্র-জীবনে কালো ছায়া ফেলে। গ্রেফতার এড়াতে বছরখানেকেরও বেশি সময় আত্মগোপনে দুঃসহ জীবন-যাপন, উচ্চশিক্ষা ব্যাহত, অনেক সময় ব্যয় করে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর বাধ্যতামূলকভাবে ভিন্ন ধারায় (ড্রাগ সেক্টরে) চাকরি নিতে বাধ্য হই এবং সে ধারাতেই জীবিকা থেকে অবসর গ্রহণ। রাজনৈতিক বন্ধু বা সহপাঠী অনেকেরই জীবনে এমন বিপর্যয় ঘটেনি। ঘটনা আমার প্রতি বিরূপ।

হারুন পাশা: এ সময় ‘নাগরিক’ নামে সাহিত্য পত্রিকা করতেন। পত্রিকাটির শুরু এবং প্রকাশ বন্ধ হওয়া বিষয়ে জানার আগ্রহ- জানাবেন?
আহমদ রফিক: মেডিকেল কলেজে; ছাত্রজীবনেই স্বপ্ন ছিল একটি উৎকৃষ্টমানের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের। বন্ধু আলীম চৌধুরীর সাহিত্য পত্রিকা ‘যাত্রিক’ তাতে জ্বালানি যোগ করেছিল। কিন্তু তখন অর্থ-সামর্থ্য ছিল না। ষাটের দশকে ‘অ্যালবার্ট ডেভিড’-এ চাকরি সুবাদে কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও কর্ম সুবাদে সাহিত্য পত্রিকা ‘নাগরিক’ প্রকাশের সুযোগ ঘটে। এ পত্রিকায় তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক সবাই লিখেছেন। শেষ দিকে লক্ষ্য ছিল তরুণদের লেখা ছেপে তাদের উৎসাহিত করা। যেমন মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান প্রমুখ।       
১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পত্রিকাটির প্রকাশ। ১৯৭১-এর ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় ‘নাগরিক’ প্রকাশ বন্ধ থাকে। এরপর জীবিকার অবস্থান বদল, বিজ্ঞাপনের সুযোগ-সুবিধার অভাব, অন্য কাজে ব্যস্ততা- সব মিলে আর প্রকাশ করা হয়নি।  

হারুন পাশা: রবীন্দ্রচর্চা করছেন। গড়েছেন রবীন্দ্রগবেষণা কেন্দ্র। জানতে চাই, রবীন্দ্রচর্চায় কেন মনোযোগী হলেন?
আহমদ রফিক: রবীন্দ্র চর্চায় মনোযোগী হওয়ার কারণ, রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে নানা দিক থেকে প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক চেতনা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব না- এটি প্রধান কারণ। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের গান, তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক এবং অন্যান্য সাহিত্যের মাধ্যমে দেশে তো বটেই, বিশ্ব দরবারে যেভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, বিশেষ করে মানবতাবাদী চিন্তায় এবং আদর্শবাদী চেতনায় যেভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন তাতে তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। পাশাপাশি আরেকটি কারণে উদ্বুদ্ধ হয়েছি সেটি হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেখা গেলো আমরা নজরুলকে নিয়ে যতোটা মাতামাতি করেছি সে তুলনায় রবীন্দ্রনাথকে উপেক্ষা করেছি। মুখেও যদি বলেছি, রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তর অংশ। কিন্তু কার্যত তাঁরা এই কাজটি করেননি। রবীন্দ্রচর্চা, বিভিন্ন সাহিত্য সৃষ্টিচর্চা এগুলোর মধ্যে আমাদের বাঙালি জাতি যেটুকু উপকার পেতে পারে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে সেইদিকে তাঁরা কখনোই নজর দেননি।

হারুন পাশা: রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র বিষয় নিয়ে এতো কাজের পরেও আপনার কি মনে হয়, আরো অনেক বিষয় বাদ রয়েছে, যা নিয়ে কাজ করা যেত বা করতে পারতেন?
আহমদ রফিক: রবীন্দ্রজীবন এবং রবীন্দ্রসৃষ্টি ও তার প্রেক্ষাপট বৈচিত্র্যের এক বিশাল ‘খেলাঘর’। সেখানে রয়েছে অনেক বিপরীত ধারা। সেগুলোর সব উৎস এখনো চিহ্নিত হয়নি। তাই রবীন্দ্রজীবন ও সৃষ্টির উৎস পুরোপুরি আলোয় এসেছে এমন কথা বলা ঠিক হবে না। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল তার এ কাজে অনেকটা পথ এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু মৃত্যু সে কাজ শেষ করতে দেয়নি। এ বিষয়ে তেমন শ্রমনিষ্ঠ কাজে খুব একটা কেউ এগিয়ে আসেননি; যদিও বেঠিক তথ্যে চমক সৃষ্টির জনপ্রিয়তার দু’একজন নাম কিনেছেন।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার লেখার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যেমন মূলত তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির বৈচিত্র্য, চরিত্র। তাতে প্রতিফলিত কার্যের জীবনদর্শনের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে, এমনকি পূর্ববঙ্গে তাঁর সমাজ সেবামূলক কর্মোদ্যোগ এবং তাঁর রচনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা বা নারী স্বাধিকার বিষয়ক প্রকাশের বিচার-বিশ্লেষণ; রবীন্দ্রজীবনের অজানা তথ্য আবিষ্কার নয়। সে সুযোগ আমার ছিল না, নেইও।    
তবে হ্যাঁ, পতিসরে রবীন্দ্রনাথের সামাজিক কর্মকাণ্ডের তথ্য-তালাশ করতে গিয়ে সামান্য হলেও কিছু নতুন তথ্য পেয়েছিলাম যার কিছু উল্লেখ রয়েছে ‘রবীন্দ্রভুবনে পতিসর’ বইটিতে। সেখানে পরিচয় মেলে মানবপ্রেমী, অসাম্প্রদায়িক ও নিম্নবর্গীয় দরিদ্র জনতাপ্রেমী কবি জমিদার রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনাতে রয়েছে বিতর্কের অবকাশ, যেমন রয়েছে ব্রহ্মচর্চাশ্রম নিয়ে, সাময়িক সংহিতা-নির্ভর হিন্দুত্ববাদী চেতনা প্রসঙ্গে। প্রতিভার ধরনই বোধ হয় এরকম। মূলত মানবতাবাদী, মানবপ্রেমী, বিশ্বশান্তিবাদী এবং যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবিরোধী রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ এবং নয়া মূল্যায়নের সুযোগ যে রয়েছে তা বলাবাহুল্য; বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ সম্পর্কিত বিষয়ে ভিন্ন মাত্রিক মূল্যায়ন। শেষোক্ত বিষয়টি নিয়ে আমার কিছু কাজ চলছে, চলছে ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ফার্সি-আরবি-সংস্কৃতির ভাষিক প্রভাব নিয়ে ভাবনা।

ধর্মীয় সংস্কৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নানামাত্রিক ভাবনাও রীতিমতো আকর্ষণীয় বিষয় যেখানে মনুষ্যত্ববোধ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের স্থানে অবস্থান নেয়। তবে আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, কবির বিজ্ঞান-চেতনা যা জীবন সায়াহ্নেও তাঁর আধুনিক চেতনার পরিচয় তুলে ধরে, যে বৈশিষ্ট্যে তিনি তিরিশের দশকের দু’একজন আধুনিক কবি-সাহিত্যিকের তুলনায় কয়েক পা এগিয়ে। পর্বান্তর যাত্রায় এমন উত্তরণে রবীন্দ্র চেতনার প্রগতি চরিত্র, আধুনিকতা ও মহত্ব গুণের প্রকাশ। এ দিকটাতে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই।

আরো গুরুত্ব দিতে চাই, দরিদ্র কৃষকের প্রতি জমিদার-কবির মমত্ববোধের মতো অভাবিত বিষয়ের দিকটিতে যা শুধু ‘গোরা’ উপন্যাসের চরঘোষপুরের বিশেষ ঘটনাতেই প্রতিফলিত নয়, প্রতিষ্ঠিত কালিগ্রাম পরগণায় গরিব চাষীর দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টায় ধার-দেনা করে স্থাপিত কৃষি ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে এবং গ্রামোন্নয়ন কর্মে। এমন কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায়নি। না-পাওয়ার কারণ রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে গভীরতর চর্চার অভাব। তাঁর সময় ও সমাজের রক্ষণশীলতা এবং শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর শাসক-তোষণের প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা রাজনৈতিক তাৎপর্যে ও সমকালীন অনেকের তুলনায় আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। অনেক উদাহরণ মিলবে তাঁর প্রবন্ধাবলীতে। জাপানি আগ্রাসনে রক্তাক্ত চীনের প্রতি সহমর্মিতা, দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়রযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নৃশংসতার এবং স্পেনে ফ্রাসকোবাহিনীর নিষ্ঠুরতার তীব্র নিন্দা বহু উদাহরণের কয়েকটি মাত্র। সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে এবং ইঙ্গ-মার্কিনি অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদও তেমনই ঘটনা।

আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে ভিন্ন মাত্রায় মৌলিক গবেষণার এমনকি নতুন ধারায় বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ এখনো রয়েছে। অবশ্য তা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে। তাঁর গানের চরিত্র বিচার নিয়ে বাংলাদেশে কাজ সামান্যই হয়েছে। যদিও তাঁর গান গাওয়া হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

হারুন পাশা: আপনি কবিতা লিখেছেন। কবিতা লিখতে আসার পেছনেও নিশ্চয় কোনো কারণ আছে? সেই গল্পটা জানাবেন
কী?

আহমদ রফিক: কবিতা লেখার পেছনে হঠাৎ কারণ বা গল্প নেই। নদীমাতৃক গ্রাম-বাংলার প্রাকৃত সৌন্দর্যে মুগ্ধ বাঙালি কিশোর-তরুণ রোমান্টিক আবেগে কবিতা লিখে হাত মক্শো করে, কেউ এ পথে নিয়মিত হাঁটে, কেউ মাঝে-মধ্যে, আবার কেউ অন্য পথ ধরে সমাজ-রাজনীতির বাস্তবতার টানে। আমার অবস্থাটা তেমনই।

হারুন পাশা: আপনি নিয়মিত কলাম লিখছেন। কেন যুক্ত হলেন কলাম লেখায়?
আহমদ রফিক: আমি বিদেশী পপুলার সায়েন্স নিয়ে লেখার ধারায় স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখা শুরু করি ‘দৈনিক বাংলার’ অনুরোধ এড়াতে না পেরে। তবে নিজের মনে যুক্তি ছিল শিক্ষিত শ্রেণীতে স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলার। এর আগে কেউ তা লেখেনি। একটানা ১২ বছর পর তা বন্ধ করে দিয়েও রক্ষা পাইনি সেবা প্রকাশনীর কাজী আনোয়ার হোসেনের জবরদস্তি থেকে। সেখানেও একই বিষয়ে এক দশকের বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য কলাম লেখা। পরবর্তীকালে একাধিক লেখক এদিকে ঝুঁকেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, মানবকণ্ঠ, জনকণ্ঠ, সমকাল ইত্যাদি দৈনিক পত্রিকায় ক্রমান্বয়ে সমাজ-সংস্কৃতি রাজনীতি বিষয়ক লেখা সম্পাদকদের অনুরোধ এড়াতে না পেরে, বছরের পর বছর লিখতে হয়েছে। বলাবাহুল্য এর লক্ষ্য শিক্ষিত পাঠক শ্রেণীকে প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। তা কতটা সিদ্ধ হয়েছে জানি না।

আমি জানি, এতে আমার মৌলিক সাহিত্যকর্ম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, অনেক আরো কিছু লেখার ছিল, জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা উপেক্ষা করতে পারিনি। তাই কলাম লেখাও বন্ধ করতে পারিনি। এখনো কলাম লিখছি, তবে তা কিছুটা কমিয়ে এনেছি। এগুলো লেখারও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।
সাহিত্যকর্ম বিচারে আমি মূলত প্রাবন্ধিক। কবিতা কমই প্রকাশিত হয়েছে পত্র-পত্রিকায়। এর একমাত্র কারণ সম্পাদকদের দাবি আমার প্রবন্ধ। কথাটা প্রকাশ্যে বলেছিলেন কবি-সম্পাদক আহসান হাবীব- উৎকৃষ্টমান প্রবন্ধের খুব অভাব। তাই সম্পাদকদের চাহিদা মোটানোও আমার প্রাবন্ধিক হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ।

হারুন পাশা: বর্তমানে দেশভাগ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাস-কবিতায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রাপ্তি হয়েছে অনেক আগেই, এত সময় পর দেশভাগ নিয়ে কেন এত লেখালেখি? আপনি নিজেও একটি গ্রন্থ লিখেছেন ‘দেশভাগ: ফিরে দেখা’।
আহমদ রফিক: দেশভাগ তথা ভারত ভাগ-বঙ্গভাগ এমন একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে এ বিষয়ে ১৯৪৭-উত্তর সময়েই গবেষণা মূলক কাজ হওয়া উচিত ছিল। ভারত-পাকিস্তান ও বিলেত-আমেরিকায় এ বিষয়ে অনেক গবেষণাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। ঘটনাটি তাদের ভাষায় ‘দক্ষিণ-এশিয় ট্রাজেডি’। মূলত অবিশ্বাস্য মাত্রায় মৃত্যু, রক্ত ও নারী নির্যাতন এবং বস্তুত আগের কারণে। পূর্ববঙ্গীয় লেখক-গবেষকগণ এ বিষয়ে চরম উদাসীনতা দেখিয়েছেন। এমনকি দাঙ্গা বিষয়ক গবেষণায়।

দেশভাগের বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। পরবর্তী সময়ে রেফারেন্স বইও সংগ্রহ করি কলকাতা থেকে। কিন্তু অন্য কাজের তাগিদে এ বিষয় নিয়ে লেখাটা শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন যা লেখা হচ্ছে ঘটনার গুরুত্ব বিচারে। এখন দরকার এ বিষয়ে মৌলিক গবেষণামূলক, বিশ্লেষণাত্মক ও মূল্যায়নধর্মী রচনা।

হারুন পাশা: এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘মৃত্যুর আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখার কাজ শেষ করে যেতে চাই’, কাজগুলো কী শুরু করেছেন?
আহমদ রফিক: না, তাৎক্ষণিকতার প্রয়োজন বলে একটি কথা আছে। কলাম লেখা বা অমুক সাহিত্য পত্রিকায় লেখা দেওয়া, এমন তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে মূল কাজ একটি অবশ্য করেছি দেশ ভাগ নিয়ে। তেমনি আরো কয়েকটি বিষয় নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সেগুলোর জন্য সময় খুব একটা হয়ে উঠছে না। তার মধ্যে বাড়তি কাজও জোটে। যেমন বাংলা একাডেমি বললো- রবীন্দ্রজীবনী লিখতে। কাজটি করতে বহু রেফারেন্স বইয়ের প্রয়োজন, বহু সময় প্রয়োজন।

হারুন পাশা: দীর্ঘ সময়খণ্ডে মানুষ, সমাজের অনেক অবক্ষয় দেখেছেন, সেখান থেকে ব্যক্তিগত উপলব্ধির কথা শুনতে চাই।  
আহমদ রফিক: জীবনের দীর্ঘ পরিসরে একাধিক শাসন ব্যবস্থার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রকাশ ও প্রভাব দেখেছি। যেমন ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন এবং ১৯৭১ ডিসেম্বর থেকে স্বদেশী শাসন। বিদেশী শাসন-শোষণ কারো কাম্য হতে পারে না বহুবিধ কারণে। সমাজ ও সংস্কৃতিতে সে শাসন ব্যবস্থার প্রভাব সুস্থ নয়। কাজেই সবাই চায় সে ব্যবস্থার অবসান। পাকিস্তানি শাসন সঠিকভাবেই চিহ্নিত হয়েছিল ‘আধা বা নব্য উপনিবেশবাদী শাসন’ হিসেবে। কাজেই শুরু হলো মুক্তির সংগ্রাম। কিন্তু স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতির সুস্থ মূল্যবোধের ক্ষেত্রে।

তাই দেখা গেছে এবং যাচ্ছে ব্যক্তিক, সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয়। সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত ব্যাপক দুর্নীতি, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত, নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত, অপহরণ-গুম-হত্যা, অনৈতিকতা ও অবৈধ জবর-দখল বাধাবন্ধহীন অবস্থায় পৌঁছেছে। নিরাপত্তা রক্ষকের ওপর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, মাদকাসক্তি সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, বিশেষ করে তরুণ সমাজে।

মূল্যবোধের এমন ক্ষয় ও বিকৃতি স্বাধীন শাসন ব্যবস্থায় কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটছে। সাম্প্রদায়িক অনাচার বন্ধ হয়নি। বরং তাতে জ্বালানি যোগ করছে সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার দূষিত অংশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ বা অভয়নগরের মতো স্থানে ইতিপূর্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা ওই দূষণের প্রমাণ। এক কথায় সুস্থ, সুশাসনের অভাব এ অবস্থার প্রধান কারণ। সেই সঙ্গে শ্রেণি স্বার্থের শাসনও বড় কারণ। অবাক হই ভেবে যে, বিদেশি শাসনামলে শিক্ষাবিভাগে সুনাম ছিল দুর্নীতিমুক্ত বলে। সেই ধারা কিছুটা পাকিস্তানি আমলেও ছিল। এখন তার পুরোটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। বড় দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক এ পরিস্থিতি।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়