ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আতর আলী

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:০৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
আতর আলী

কলকাতার মারকুইজ স্ট্রিটে সব সময় বাংলাদেশি গিজগিজ করে। দু’পাশের আবাসিক হোটেলগুলোতে কখনোই সিট খালি থাকে না। এখানে পিক সিজন বলে কিছু নেই, সারা বছরই চিকিৎসা, বেড়ানো, কেনাকাটা ইত্যাদি উপলক্ষে বাংলাদেশিদের ভিড় লেগেই থাকে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার অফিসগুলোও এখানে। সরু রাস্তায় সার দিয়ে বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকলে চলাচলে খুবই সমস্যা হয়। খাবার হোটেল, মানি চেঞ্জারের অফিস, প্রসাধনী, কাপড়-চোপড়ের দোকান— সব মিলিয়ে এলাকাটা অনেক রাত পর্যন্ত খুব জমজমাট থাকে। এখানে এলে দেশের পরিচিত দু’একজনের সঙ্গে দেখা হয়েই যায়।

বাবার চিকিৎসার ফলোআপের জন্য আরিফকে বছরে দু’তিনবার এখানে আসতে হয়। সাধারণত শীতের সময় সে খুব আসতে চায় না, কারণ তখন ভ্রমণকারীদের অতিরিক্ত চাপ থাকে। অনেক সময় ফোনে হোটেল রুম বুক করে এলেও পাওয়া যায় না। বেশি টাকা পেলে ওরা অন্যদের দিয়ে দেয়। কিন্তু এবার আর না এসে পারেনি, কারণ বাবার নতুন কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। কালই ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। রাতের খাবার খাইয়ে বাবাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে সে একটু বেরিয়েছে। সারাদিন সিগারেট খেতে পারেনি। রাতেও না খেতে পারলে ঘুমই হবে না। আনমনে সিগারেট টানতে টানতে সে কলিন স্ট্রিটের মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ায়। মোড়ের এক কোণে রাস্তার আলো-আঁধারির মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে এক বৃদ্ধ আতর বিক্রি করছেন। রাত প্রায় সাড়ে দশটা তাও উঠবার নাম নেই। প্রচণ্ড শীতে কাবু হয়ে আছেন বোঝা যায়। মাথার টুপিতে কান ঢেকেছেন, রুগ্ন শরীর একটা ঢোলা এবং জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া কোটের মধ্যে সেঁধানো, গলায় একটা উলের মাফলার জড়ানো, সামনে পেতে রাখা চটের ওপর ছোট-বড় শিশিতে সারি সারি নানা রঙের আতর সাজানো। আরিফ আতর মাখে না, গন্ধ এলার্জি আছে। যেকোনো আতরের গন্ধ নাকে গেলে হাঁচতে হাঁচতে জীবন শেষ। কিন্তু বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকটা সম্মোহিতের মতো সে তার দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আতর নেবেন বাপজি? অনেক রকমের আতর আছে আমার কাছে।

আরিফ নিঃশব্দে তার সামনে বসে। কাঁচের শিশিতে সাজিয়ে রাখা নানা রঙের আতর দেখতে থাকে। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বৃদ্ধ উৎসাহের সাথে নানা রকমের আতরের বর্ণনা দিতে থাকেন— এই যে দেখতেছেন, এটার নাম ‘শামামাতুল আম্বার’। কস্তুরীর সঙ্গে চন্দন মেশায়ে এই আতর তৈয়ার করা হয়। আর এই যে, এই আতরের নাম ‘আলফ জোহরা’, ফুলের রস থেকে তৈরি। আর এটার নাম ‘ফাওয়াকি’। এটা ফলের রস থেকে বানানো হয়। বুঝলেন বাপজি, আতর বানাতে মৃগনাভি কস্তুরী, আগর, ফুল ও ফলের রস লাগে। কোনটা দোবো?

আরিফ আতর না মাখলেও তার বাবার খুব পছন্দ। কলকাতায় এলে প্রতিবারই তিনি কোনো না কোনো আতর কিনে নিয়ে যান। আর প্রতিবারই আতরের শিশি হাতে নিয়ে একটাই গল্প বলেন। এই গল্প যে কতবার শুনেছে সে তার ঠিক নেই। ১৫৪০ সালে কনৌজের যুদ্ধে শেরশাহের কাছে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন দীর্ঘদিন নিঃস্ব ও মানবেতর জীবন যাপন করেছিলেন।  এরই মাঝে ১৫৪২ সালে তার পুত্র আকবরের জন্ম হয়। সন্তানের জন্ম উদযাপনে কাউকে আপ্যায়ন করতে না পেরে বিমর্ষ হুমায়ুন সবার মাঝে আতর বিলিয়ে বলেছিলেন, আতরের সুঘ্রাণের মতো তার ছেলের খ্যাতি যেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কি মনে করে বারবার এই গল্প তার বাবা বলতেন আরিফ জানে না। হয়তো নিজের সন্তানকে নিয়েও তেমন কোনো আকাঙ্ক্ষা তার মনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। বাবার আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ হয়েছে সে জানে না। তবে শিক্ষক ও সমাজতাত্ত্বিক গবেষক হিসেবে তার খ্যাতি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

একটা সিসি দেখিয়ে আরিফ জানতে চায়, এটার একতোলার দাম কত হবে চাচামিয়া?

এক হাজার টাকা। আপনি শেষবেলায় আসছেন একশ টাকা কম দিয়েন। এটার নাম হলো মেশক আম্বার। শিশিটা হাতে নিয়ে সাদা একটা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে কাঁপাকাঁপা গলায় বলেন বৃদ্ধ।

আতরের দাম এমনই— আরিফের সেটা অজানা নয়। তারপরেও কেন যেন তার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, এত দাম!

তার কথা শুনে বৃদ্ধ হেসে ফেলেন। বলেন, আমার কাছে দশ হাজার টাকা তোলা দামের আতরও আছে বাপজি।

বেশ আমাকে এটার এক তোলা দেন।— আরিফ বলে।

বৃদ্ধ পাশে রাখা কাঠের বাক্স থেকে একটা শিশি বের করে তাতে খুব যত্ন করে আতর মেপে একটি ছিপি এঁটে দেয়। সেটা তার হাতে দিতে দিতে হঠাৎই বৃদ্ধ প্রশ্ন করেন, বাপজি তো বাংলাদেশ থেকে আসছেন, তাই না?

জ্বি, কী করে বুঝলেন?

না বুঝার কি আছে? এইখানে তো আমাদের ব্যবসাপাতি চলে বাংলাদেশের লোকজনের জন্যই। এই যে খাবার হোটেল, থাকার হোটেল, গাড়ি ঘোড়ার ব্যবসা দেখছেন সবই চলে ওপাশের লোকজনের জন্য। দোকানপাটের মালিক-কর্মচারী সব কলকাতার, কিন্তু খদ্দের সব বাংলাদেশের, না হলে এখানকার লোকজন কি আর এখানে থাকে-খায়? তা বাংলাদেশের কোন জায়গায় বাড়ি বাবা?  

খুলনা।

খুলনা! বিস্ময়ের সাথে উচ্চারণ করে বৃদ্ধ। দীর্ঘদিনের হারিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস হঠাৎ খুঁজে পেলে মানুষ যেমন বিস্মিত হয়, তার চোখে-মুখে তেমনি বিস্ময় লক্ষ্য করে আরিফ। তাতে তার মনে হয়, যে কৌতূহল তাকে বৃদ্ধের কাছে টেনে নিয়ে এসেছিল তার জট বোধহয় এখন খুলতে চলেছে। আতর কেনা নয়, তার সঙ্গে কথা বলাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল। কারণ তার মনে হয়েছে, এই বয়সে এত রাতে শীতের মধ্যে যে মানুষ দুটো পয়সার জন্য আতরের পসরা সাজিয়ে বসেছে তার জীবনের গল্পটা খুব সরল হতে পারে না। অভিজ্ঞতাও প্রচুর। যদি তার থেকে দরকারি কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক উপাদান পাওয়া যায়! আরিফ জানতে চায়— আপনি খুলনা চেনেন, চাচামিয়া?

তার কথায় বৃদ্ধ মৃদু হাসেন। পাশে রাখা একটা নিচু কাঠের ছোট্ট চৌকি এগিয়ে দিয়ে বলেন, বসেন বাপজি।

প্যান্ট পরে নিচু ওই চৌকির উপর বসতে আরিফের অসুবিধা হলেও আড়াআড়ি পা ভেঙে সে বসে পড়ে। বলে, কবে গেছিলেন বাংলাদেশে?

সালটা ঠিক মনে নেই, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বেশ পর যখন প্রফুল্ল ঘোষ মুখ্যমন্ত্রী ছিল। আর ওপাশে তখন আইয়ুব খাঁর শাসন।

কেন গেলেন?

এখানে তখন খাদ্য খাবারের খুব অভাব। দু’বছর আগে আমার দাদা গিয়েছিল। দাদা চিঠি করল, এদেশে খাদ্য-খাবার খুব সস্তা, অসুবিধে হলে চলে আয়। এখানে তখন আমি চটকলে কাজ করি, ১৮ টাকা হপ্তা, বউ আর দুটো বাচ্চা নিয়ে ঠিকমতো চলতো নি। তো, দাদার কথায় ওখানে চলে গেলুম।

ওখানে কি কাজ করতেন?

ওখানেও চটকলে কাজ করতুম, ২৮ টাকা হপ্তা, জিনিসপত্রের দাম কম ছিল, খুব ভালোভাবে চলে যেত।

কোন চটকলে কাজ করতেন? আরিফের কৌতূহল বেড়ে চলে।

খুলনার স্টার জুট মিল। ওখানে ভালোই চলছিল। তারপর গন্ডগোল বেধে গেল। শেখ মুজিবর ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করলো, আইয়ুব খাঁকে বলল, এদেশ ছেড়ে দাও। ওরা বললো, না ছাড়বো নি। তখন বেধে গেল আরকি।

এমনভাবে বলেন বৃদ্ধ যেন কোনো শিশুকে ঘুমপাড়ানোর জন্য তার দাদা-নানা গল্প শোনাচ্ছে। তার বলার ধরনে আরিফ খুব মজা পায়।

সেটা কি ৬৯ সালের দিকে? সে প্রশ্ন করে।

হতে পারে বাপজি। অতো তো আর মনে নেইকো, তবে তখন আইয়ুব খাঁকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খাঁ ক্ষমতায় বসেছিল। আর ক্ষমতায় বসেই সে মিলিটারি নামিয়ে দিলো, মাশায়াল্লা দিলো।

মাশায়াল্লা! সেটা কী?

হাঁ, মাশায়াল্লা, খুব কড়া আইন। বলা হলো, কেউ যদি দরজা-জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে। তারপর তো জোরমত গন্ডগোল বেঁধে গেল।

গন্ডগোল! মানে যুদ্ধ।

হাঁ, যুদ্ধ।

আপনারা তখন কী করলেন?

কি আর করব? যেখানে ছিলাম, মানে খালিশপুরে এক মুসলমানের বাড়িতে, সেখানেই থাকলাম। এদেশ থেকে যেসব মুসলমান ওখানে গিয়েছিল তারা অনেকেই আশপাশে থাকতো। তার মধ্যে অনেক বিহারী ছিল। তাদের অনেককে কেটে কুঁচিয়ে নদীতে ফেলল, কারণ ওরা পাকিস্তান চাইতো। আমরা যেহেতু বাংলা ভাষায় কথা বলতাম আমাদের কিছু বলেনিকো। ওরা শুধু বলতো, বিহারীদের এদেশে রাখবো না। ওরা গাদ্দার।

যুদ্ধের পুরোটা সময় ওখানেই ছিলেন?

কী করব? আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল নি। রাতে গোলাগুলির শব্দ, ভয়ে ঘুম হতো না, সারারাত জেগে বসে থাকতুম। এরপর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ইন্ডিয়ান মিলিটারি যোগ দিলো, তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, শেষমেশ তো পাকিস্তানিরা সারেন্ডার হয়ে গেল। দেশটা একটু ঠান্ডা হলো।

যুদ্ধের সময় কি কল কারখানা চলত?

না, চলেনি। যুদ্ধ থামার পর অনেককে ছাঁটাই করার পর কল কারখানা চালু হলো বটে, কিন্তু বেশিদিন চলল না।

কেন?

ওদেশের শ্রমিকরা বলল, আমরা এখন স্বাধীন আমরা কাজ করবো কেন? আর এভাবেই ধীরে ধীরে কল-কারখানাগুলো আবার বন্ধ হয়ে গেল। তখন ছেলেপুলে নিয়ে না খেতে পেয়ে আবার এখানে ফিরে এলাম।

আবার ফিরে এলেন! বারবার এভাবে আসা-যাওয়া করলেন বর্ডারে আটকায়নি?

কে আটকাবে? দু’বারই কিছু খরচা করতে হলো, আর দালালেরা পার করে দিলো। পুলিশ-টুলিশ সবই ওদের বন্দোবস্ত ছিল।

এক নাগাড়ে কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন। শীতের রাত, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, পাশে রাখা একটা বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেলেন।

এবার আরিফ আরেকটু পিছনে গেল। গবেষকের চোখ দিয়ে সে তাকে দেখছে। সে আসলে জানতে চায়, একটা মানুষ যে বারবার উন্মুল হলো দেশভাগের কারণে, সে সম্পর্কে আদৌ তার কোনো ধারণা আছে কিনা।

আপনার দেশভাগের কথা মনে আছে? সামনে ঝুঁকে পড়ে জানতে চায় আরিফ।

আমার জন্ম দেশভাগের আগে, ১৯৪১ কি ৪২ সালে। বাপজানের মুখে শুনেছি ভাগাভাগির সময় খুব বড় একটা দাঙ্গা হয়েছিল হিন্দু-মুসলমানে। তখন নাকি উঠতে বসতে শোনা যেত এইসব মুসলমানদের মেরে পাকিস্তানে পাঠাবো। কিন্তু আমরা যেখানটাতে ছিলাম সেখানে খুব সমস্যা হয়নি। তখন যেতে হয়নি, পরে গিয়েছিলাম অভাবের কারণে। আর ওই যে বড়দা বললো চলে আয়। তাও তো থাকা হলো না। আবার ফিরে আসতে হলো।

আপনার দাদা কী করলেন?

সেও চলে এলো দু’বছর পর।

আচ্ছা আপনার কি মনে হয় একটা দেশ হলেই ভালো হতো?

নিশ্চয়ই। এতো টুকরো টুকরো না করে একটা হলেই ভালো হতো। দেশটা ভাগ করাই ঠিক হয়নি।

আচ্ছা ভাগ করার কারণ আপনি জানেন?

ভেতরের খবর কি আর খুব বেশি জানি বাপজি। সবাই বলে ঐ হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া। কিন্তু আগে তো ঝগড়া ছিল না। ইংরেজরা ঝগড়াটা বাঁধিয়ে দিয়ে গেল। সব ওই লালমুখো জাতের চালাকি।

এখন কেমন আছেন চাচামিয়া? এখন হিন্দুদের সাথে লাগে না?

বাপজি, অনেক হাঁড়িপাতিল একসঙ্গে থাকলে মাঝে মাঝে একটু ঠোকাটুকি লাগে। তারপরও সেগুলোকে এক জায়গায় পাশাপাশিই রাখতে হয়।   

একথার পর বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল আরিফ। হিসাব কষে ভাবলো, এমন সরল-সোজা মানুষের সংখ্যা কত? যারা জীবন মানে বোঝে দুটো খেয়েপরে বেঁচে থাকা। বড় কোনো স্বপ্ন নেই, তবে সবার সাথে মিলে মিশে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আছে। জাত-পাত নিয়ে অত ভাবে না। তবে যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবে তারা সহজেই এই মানুষগুলোকে নিয়ে খেলতে পারে। সমস্ত মানবিক বোধগুলো ওদের জেদ আর প্রতিহিংসার অধীন। আঘাত করার মধ্যেই রয়েছে বীরত্ব। ধর্ম মানুষকে যতটা কাছে টেনেছে তারচেয়ে দূরে ঠেলেছে বেশি। ধর্মের চিরস্থায়ী ফল হলো হিংসা, মনের মাঝে লুকানো বিদ্বেষ। দেশটাযে ভাগ হলো তাতে সবটাই যে লালমুখো জাতের চাল ছিল না, আরো অনেক বিষয় ছিল। এই বৃদ্ধের মতো অতি সাধারণ মানুষরা তা কোনোদিন বুঝতে পারলো না। এগুলো এদের মাথায়ই ঢোকে না। না ঢোকাই ভালো। তাতে এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষগুলোকে হাঁড়িপাতিলের ঠোকাঠুকির মতো লঘু করে দেখার উদারবাদী ভাবনাটা মন থেকে উবে যেতে পারে। ‘মানবতা’ শব্দটা বোধহয় এদের কারণেই বেঁচে আছে যারা কখনোই অন্যের মনে কষ্ট দেয় না, কাউকে ফাকিঁ দেয় না।

চাচামিয়া, এইটেই তো এখন আপনার দেশ, ভালোবাসেন এই দেশটাকে?

একথার উত্তরে অদ্ভুত হাসেন বৃদ্ধ। তারপর বলেন, আমরা দেশরে ভালোবাসি— একথা কইলে লোকে হাসে, বিশ্বাস করে না।

আরিফ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারোটা। উঠতে হবে। পকেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে বৃদ্ধের হাতে দেয় সে। বৃদ্ধ ১০০ টাকা ফেরত দিতে গেলে সে টাকাসহ হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে, রাখেন ফেরত দিতে হবে না। চৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়ায় সে। বৃদ্ধের চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরপার খেতে থাকে। জীবনের অভিজ্ঞতায় এতটুকু সুখ নেই। জানে না রাজনীতির দাবা খেলা, চেনে না তার চোরাগলি। কিন্তু সেই খেলার ঘুঁটি হয়েছিল সে, তার মতো কোটি কোটি মানুষ। নিরাপদে বাঁচতে একবার ছুটে গেল তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানে। আবার একাত্তরের পর ফিরে এলো এদেশে। আসলে দেশ কী? ভাবে আরিফ, দেশ মানে কি একটি ভূখণ্ড? মাটি? আর কিছু নয়? দেশ মানে সার্বভৌমিক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মাঝে সরকার, জাতি, সম্প্রদায় এতসব এই বৃদ্ধ মানুষটি বোঝে না বলেই কি তার এই দুর্গতি? যে মাটিতে কখনোই তার পা শক্ত হলো না সে কী করে ভালোবাসবে সে মাটিকে? দেশপ্রেম হলো একটা বোধ। বারবার ঘা খেয়ে খেয়ে তা ভোঁতা হয়ে গেলে বোধটা আসবে কোথা থেকে? উদ্বাস্তু জীবনে অস্তিত্ব ব্যাতিরেকে দেশ, দেশপ্রেম শব্দগুলো ওদের কাছে খুব অর্থ বহন করে না। ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত এক বিষণ্নতা চেপে বসে আরিফের বুকে।

ওহো, লোকটার নামতো জানা হলো না। ফিরে গিয়ে জেনে আসবে? দুর! নামে কি যায় আসে? ধরা যাক বৃদ্ধের নাম আতর আলি। সারা জীবন মানুষের পুঁতিগন্ধময় চেহারা দেখে দেখে আজ ৮০ বছরে পা রেখেছেন। আজও তেমনি দুর্গন্ধময় পরিবেশের মধ্যে বসে সুগন্ধি বিক্রি করছেন। গায়ে মেখে মানুষ সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে নিশ্চয়ই কিন্তু সেই সুঘ্রাণ তাদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করছে কি? সেই বীভৎস বিদ্বেষের পরম্পরা তারা ভুলতে পেরেছি কি? আতর আলীর ভাঙা তোবড়ানো গালের মধ্যে আরিফ দেখতে পায় বিভাজিত মানচিত্র। আর কপালের বলিরেখায় দীর্ঘ জীবনের পরিশ্রান্ত পদচিহ্ন আর বেদনার দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়