ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

অগ্নিশিখার অশ্রুবিন্দু ও একটি দিবসের নারী

পাপড়ি রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০১, ৮ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৯:১৩, ৮ মার্চ ২০২১
অগ্নিশিখার অশ্রুবিন্দু ও একটি দিবসের নারী

মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট [১৭৫৯-১৭৯৭] আপাতবিষম সুন্দর ও ভয়াবহ এক চিত্রকল্পে নারীকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন অগ্নিশিখার অশ্রুবিন্দু! মনে প্রশ্ন জাগ্রত হতেই পারে- এ আবার কী! আগুনের কি নয়ন আছে? আচ্ছা, মনে করা যাক আগুনের নয়ন, চক্ষু যাই হোক কিছু একটা আছে; বা তা না হয় নাই-ই থাকলো। তবুও কিছু একটা হয়তো ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে সেই অগ্নিচক্ষুতে অশ্রুবিন্দুরও সাক্ষাৎ পাওয়া! সত্যিই কি তা দেখা যায়? দেখা দেবে? আগুনের সঙ্গে জলের যে চিরকেলে বিপ্রতীপ সম্পর্ক, তাকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ করে এই যে মেলাবার চেষ্টা তাকেই-বা কী অভিধায় ডাকা যেতে পারে? বা আদৌ তাকে কোনো অভিধায় ফেলা যায় কিনা?

আমি বা আপনি যখন নানান ধন্দে-ছন্দে, মহানন্দে ঘুরপাক খাচ্ছি, তখন একটু তেরছা করে অন্যকিছুও তো ভাবা যেতে পারে। হাতের কাছে, নয়ন সন্মুখে কাকেই-বা আর পাবেন রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া?
নয়ন সন্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই
নাহি জানি, কেহ নাহি জানে
তব সুর বাজে মোর গানে...

আহা! আমি বা আপনি কোন স্যার? স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যে এই ধন্দে পড়েছিলেন। 
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী
গোষ্ঠে যবে নামে সন্ধ্যা শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বালো সন্ধ্যাদ্বীপখানি
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল লজ্জিত বাসরশয্যাতে  অর্ধরাতে
উষার উদয়-সম অনবগুন্ঠিতা তুমি অকুণ্ঠিতা।
Beautiful one, who is not mother nor daughter, nor consort, but a celestial being on earth.

এই যে সুন্দরী রূপসী; হতে পারে এটাই সেই অগ্নি। আর Celestial being on earth হয়তো এটাই সেই অশ্রুবিন্দু। কিন্তু এই অগ্নি বা অশ্রুর দুটোই থাকে আড়ালে, থাকে আবডালে। যেমন চাঁদ ঢাকা পড়ে থাকে মেঘের আড়ালে বা সুশোভিত মেঘের স্তরে ঘুমিয়ে থাকে বিজলীর রোষের তরবারি। শুধু প্রয়োজনেই সেই তরবারি, মেঘ-বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। সেই বিদ্যুত-ই ক্রমে হয়ে উঠতে পারে বারুদ আর করে দিতে পারে সব ভস্মীভূত।

অগ্নির চাইতে কিন্তু অশ্রুবিন্দু আরও বেশি দুর্লভ। আরও বেশি মিস্টিয়েরিয়াস এবং সাধনার। এই অশ্রুর দেখা পেতে হলে আপনাকে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে। বা আপনাকে হতে হবে সেই নাইটিঙ্গেল পাখিটি। বুকের নরম-কন্দরে স্বেচ্ছায় বিঁধিয়ে নিতে হবে কন্টকের বেদনা আর জ্বালা। নিজের লোহু বইয়ে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে সেই বহু কাঙ্খিত রক্তগোলাপ। তবেই না দেখা পাওয়া যেতে পারে সেই মহামূল্যবান অশ্রুবিন্দুটির।

মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের সেই বিখ্যাত বই ‘আ ভিন্ডিকেইশান অব দ্য রাইটস অব উইমেন’-এর দুনিয়া তোলপাড় করা চিন্তাসমূহ মেরিকে যতো-না খ্যাতি দিয়েছিল, নিন্দা দিয়েছিল তার চাইতেও অধিক। মেরি দেখিয়ে ছিলেন কী করে আগুনের মাঝেই অঝর-অশ্রু ঝরে পড়া যায়, ফের অশ্রুর মাঝেই দাউ-দাউ-আগুনের লেলিহান অগ্নিশিখা রূপে কীভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে কেউ?

I earnestly wish to point out in what true dignity and human happiness consists. I wish to persuade women to endeavor to acquire strength, both of mind and body, and to convince them that the soft phrases, susceptibility of heart, delicacy of sentiment, and refinement of taste, are almost synonymous with epithets of weakness, and that those beings are only the objects of pity, and that kind of love which has been termed its sister, will soon become objects of contempt.
[Mary Wollstonecraft, A Vindication of the Rights of Woman]

মেরির বই প্রকাশের পরপরই ক্ষেপে ওঠে রক্ষণশীলেরা। অশ্লীল গালাগালিতে ভরে ফেলে চারপাশ। হোরেস ওয়ালপোল মেরিকে বলেন ‘পেটিকোট পরা হায়েনা’। আরেজন বলেন ‘দার্শনিকতাকারিণী সর্পিনী’। মেরি তাদের চোখে হয়ে ওঠেন অশুভর নারীমূর্তি। আর এই পৃথিবীর নিন্দুকেরা তখনো ছিল, এখনো আছে। এবং তারা চিরকালই থাকবে। তারা ছিল উনিশ শতকে, বিশ শতকের অর্ধেক ভরেও তারা ছিল এবং আছে আজও। ভবিষ্যতেও তারা থাকবে বহাল তবিয়তেই।

It is time to effect a revolution in female manners - time to restore to them their lost dignity - and make them, as a part of the human species, labour by reforming themselves to reform the world. It is time to separate unchangeable morals from local manners.
[Mary Wollstonecraft, A Vindication of the Rights of Woman]

কিছুদিন আগ পর্যন্ত নারীবাদীরাও সংকোচ করতো তার নাম নিতে, ভয়ে কুকড়ে যেতো একথা ভেবে যে, মেরির নাম নিলে পুরুষতন্ত্র ক্ষেপে উঠবে, হয়তো তাঁদের কোনো দাবি আর পূরণ হবে না। মেরি সমস্ত ‘সদ্গুণের’ বিনাশকারিণী, তাঁর নাম নিলে হানি ঘটবে সতীত্বের। কিন্তু বহুকাল বাদে আজ জয় হয়েছে মেরিরই, যিনি বত্রিশ বছর বয়সে লিখেছিলেন একটি বিপজ্জনক বই, এবং অবাক বিস্ময়ে অশ্রুর মতোই মিলিয়ে গিয়েছিলেন দ্রুত, মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। কিন্তু মেরি যতদিন বেঁচে ছিলেন, ছিলেন দাউদাউ-অগ্নিশিখার মতো। আর মিলিয়ে যখন গেলেন— মিলিয়েও গেলেন কিনা এক লহমায়, একেবারে অশ্রুবিন্দুর মতো। কিন্তু আজ এত বছর বাদে সেই মেরিই পাচ্ছেন নারীবাদী সন্তের মহিমা;  মার্ক্স যেমন সমাজতন্ত্রের, মেরি তেমনই নারীবাদের। তাঁর সমাধিতে মৃত্যুর একশ একষট্টি বছর পর দ্বিশতবার্ষিকীতে অর্পিত হয়েছে পুষ্পার্ঘ্য। বেদীতে নেমেছে পুষ্পের ঢল।

অগ্নিশিখা আর অশ্রুবিন্দুর এই বিপ্রতীপের সম্মিলন ঘটবার পরও পেরিয়ে গিয়েছে  আরও প্রায় দুইশ ত্রিশ বছর। এই দুইশ ত্রিশ বছরে এসেছে আরও শত শত নতুন মতবাদ। ঘটেছে নব নব আন্দোলন। কিন্তু নারীর অবস্থান তাতে কতোটা বদলেছে? একথা তো সত্য, গত দুই শতাব্দীর অধিককাল সময়ে নারী ক্রমশ হয়ে উঠেছে আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক। নারীর হাতের নাগালে রান্নাঘরের তৈজসপত্রের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে উড়োজাহাজের ডানা। ফলত তার দুই হাতে ঘুরেছে যানবাহনের যান্ত্রিক-হুইল। আর সেই হুইল বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়িয়েছে বড়বড় হাওয়াই জাহাজ। চন্দ্র বিজয়ের ইতিহাসে নাম লেখা হয়েছে  নারীর। এবং সেইসঙ্গে নারীর কোমল-মুঠোতে উঠে এসেছে হাতুড়ীর মতো কঠিন-হাতিয়ার । কিন্তু নাহ, এ হাতিয়ার নারীর যুদ্ধ জয়ের জন্য ব্যবহৃত হয় নাই। নারীর যুদ্ধে থাকে অগ্নি আর অশ্রুর সম্মীলন। থাকে নীরবতা আর বিসর্জন। তাই নারীর মুঠোতে ধরা এই নতুন হাতিয়ার আরও বেশি নাজুক করে তুলেছে তার অবস্থান। এই হাতুড়ীর আঘাতে নারী ভেঙেছে ইটের-পাহাড়। ভেঙেছে পাথরের পর পাথর। নারীর নাজুক হাতে ছাপ ফেলেছে শ্রমিকের পরিশ্রম। পাথর ঠুকে,  ইটের পাঁজর ভেঙে ভেঙে কমলারঙা-আগুনে নারী অবিরাম লিখে গিয়েছে নিজের ঘাম, শ্রম, পরাজয় আর বেদনার ইতিহাস। 

০২

১৮৪৮ সালের এক ঘুমন্ত-গ্রাম। নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস-এ প্রথম সংঘটিত হয় নারীদের প্রথম জমায়েত একটি চার্চ বা উপসনালয়ে। বত্রিশ বছরের এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন প্রথম বক্তৃতা দেন। নারীদের সম্পর্কে পুরুষদের যে ভূমিকা, ভুল বিচার, চিরকালই ভুল মূল্যায়ন হয়েছে। সেই ভুল সংশোধন কল্পে নারীদের নেমে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে ভুলগুলো শুধরে দেওয়ার জন্য। প্রতিটা নারীর নিজেরই বুঝতে হবে তার উচ্চতা, তার গভীরতা, তার বিস্তার ও ব্যাপকতা। বুঝতে হবে কী কারণে বা কেনই-বা তার এই দলিত রূপ? কেনই-বা তার উপর চলছে যুগের পর যুগ ধরে এই নির্যাতন? কেন তাকে সবকিছুতেই দেখা হচ্ছে ‘ঊন’ বা খাটো করে? এমন নয় যে, এগুলো শুধু কথার কথা! এসবই তো সত্য। কিছুতেই নয় কথার কথা। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, কয়েক যুগ আগেও তো ইউনাইটেড স্টেইটসেও অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া নারীদের পড়াশোনার সুযোগও ছিল না। নারী ছিল প্রায় সর্বক্ষেত্রেই প্রায় নিষিদ্ধ। নারীদের ভোটাধিকার ছিল না, এমনকি তারা ভোটেও দাঁড়াতে পারত না। শুধু তাই নয়, পুরুষদের ছিল অবাধ যৌন-স্বাধীনতা। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছুতেই নয়।

বিবাহিত নারীরা পুরুষদের সর্বক্ষেত্রেই খুশি করে চলার চেষ্টা করত। কিন্তু স্বামীদের ছিল স্ত্রীদের উপর অবাধ নিয়ন্ত্রণ। এমনকী স্ত্রীদের রোজগারও তারা যথেচ্ছ ব্যবহার করত। নারী ছিল সর্বাদাই পুরুষের চোখে হীন ও করুণার পাত্র।

১৮৬০ এ ন্যাশনাল উইমেন্স রাইট সম্মেলনে আর্নেস্টাইন রোজ ঘোষণা করেন- বন্ধুগণ, নারীদের স্বাধীনতা তো আর মেঘ থেকে নেমে আসবে না, বা তা উল্কার মতোও নয়। যা এই এক রাতের মাঝেই ফুটে উঠবে না। বা তা বড় বড় প্রয়াসে বা বড় কোনো আত্মত্যাগেও আসবে না। যারা নিজেদের মর্যাদার প্রশ্নে সোচ্চার হতে চাও, তাদের সোচ্চার হতে হবে। এবং অনেক ঘাম ঝরিয়ে তা অর্জন করতে হবে। এবং সত্যি কথা, অনেক ঘাম ঝরিয়ে, অনেক পরিশ্রম করেই পাশ্চাত্য নারী স্বাধীনতা পেয়েছে। পেয়েছে নারীর অধিকার।

০৩

নারীর ঘাম আর শ্রমের অধিকার আদায় ও নায্যমূল্যের দাবীতে সৃষ্টি হয়েছে একটি দিবস- ৮ মার্চ বিশ্ব নারীদিবস। নারী কাকে বলে? দ্য বোভোয়ার বলেছেন, এর উত্তরে একধরনের পুরুষ বলে, ‘নারী হচ্ছে জরায়ু, ডিম্বকোষ; নারী হচ্ছে স্ত্রীলোক। পুরুষ এমন অসংখ্য সংজ্ঞা দেয় নারীর, যার সবটাই নিন্দাসূচক। কোনো কোনো নারীকে দেখিয়ে তারা বলে, সে নারী নয়, যদিও তার জরায়ু-স্তন-যোনি সবই রয়েছে। ওই নারীর মধ্যে তারা দেখতে পায় নারীত্বের অভাব, চিরন্তন নারীর উনতা। তারা চায় নারী হবে নারী, থাকবে নারী, আর হয়ে উঠবে নারী। পুরুষ চায় শাশ্বতী নারী, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। চিরন্তনী বা শাশ্বতী হচ্ছে পুরুষের এক চিরকালীন চক্রান্ত বা ক্ষুধা। সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সামান্যদের সোহাগ খরিদ করে/ চিরন্তনী অভাব মেটাতে হবে’, তবে কোটি মন্বন্তরেও তিনি ভুলতে পারবেন না শাশ্বতীকে; পুরুষের কামনার সাথে না মিললে নারী মাত্রই পুরুষের কাছে সামান্য; জরায়ু-যোনি-স্তনের সমষ্টি, নিজের লিংগে ও যৌনতায় বন্দী পশু। পুরুষ ও স্ত্রী বা নর ও নারী ব্যাকরণে দুটি সুষম রূপ বোঝালেও জীবনে বোঝায় দুটি ভিন্ন মেরু। পুরুষ ও নারী নির্দেশ করে দ্বিমুখী বৈপরীত্য: পুরুষ বোঝায় সমস্ত সদর্থক বা অস্তিবাচক গুণ, আর নারী বোঝায় কদর্থক বা নঞর্থক বৈশ্যিষ্ট্য।
কিন্তু এইসব মিথ্যা দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে আর কতকাল? এসব থেকে শুধু নারীকে নয় পুরুষকেও উদ্ধার পেতে হবে। যে দ্বান্দ্বিকতার মুখোমুখি আমাদের নিয়তই দাঁড় করানো হয় সেগুলিও আবশ্যক নয়। আপাতবিচ্ছিন্নদের নৈকট্যসাধনই, আপাতবিপরীতদের সমন্বয়সাধনই মনুষ্যধর্ম। সে সাধনায় উভয় লিঙ্গই যাতে উত্তীর্ণ হতে পারে তার জন্য উপযুক্ত নির্ভরস্বরূপ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, নারী আর পুরুষ মিলিতভাবে চেষ্টা করে যদি।

তার জন্যে সবার আগে মুক্ত করতে হবে বুদ্ধিকে। বর্জন করতে হবে যোদ্ধাসুলভ সেই চিন্তাভঙ্গী, যা জীবনের যাবতীয় জটিলতাকে সরলীকৃত করে নিয়ে প্রথমেই নির্দিষ্ট করে একটি শত্রুকে। তারপর তাকে বিনাশ করতে ঝাঁটার মতো এগিয়ে যায়, বিনা দ্বিধায় ‘ফরাসী-বিল্পবী-কায়দায়’। জীবনের সূক্ষ্ম সমস্যাগুলোর সমাধান ওভাবে হয় না। তার জন্য লাগে আরও সংবেদন, আরও বহুমাত্রিক প্রতিন্যাস, সূক্ষ্মতর পরিকল্পনা এবং তার সযত্ন বাস্তবায়ন।

নারী ও পুরুষ এই দুই লিঙ্গের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু পার্থক্য মানে এই নয় যে, একটি অপরটি থেকে নিকৃষ্ট। যেগুলো তথাকথিত মেয়েদের কাজ সেগুলো কোনো বিচারেই তথাকথিত পুরুষদের কাজের চেয়ে গুরুত্বহীন নয়। আজকের মেয়েরা কীভাবে কাজ করবে, কী কী কাজ করবে, কীভাবে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হবে এ-সমস্তর মীমাংসা হবে মেয়েদেরই জীবনের প্রয়োজন অনুসারে [‘Adaptation of women’s work and pray to a woman-shaped life’] এবং নীতি হবে লিঙ্গ- নির্বিশেষে সব মানুষের শ্রমকে এবং তার মূল্যায়নকে মন্যুষ্যোচিত ক’রে তোলার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অন্তর্গত [‘Part of a wider attempt to adapt everybody’s work and pay to a human-shaped life’], কেননা কর্ম জীবনে যে মডেলটা পুরুষেরা এ যাবত গড়ে তুলেছেন সেটা কোনো নিখুঁত মডেল নয়।
 [‘The exisiting and supposedly man-shaped career suits many men as well as women very badly’]

০৪

নারীবাদ বা feminism নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। নরম, উগ্র, গরম, কোমল সব রকম হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত নারী সত্তার উন্মেষ ঘটেছে কি? বা পুরুষরাই প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে কি? নারী কি পেয়েছে তার যোগ্য মর্যাদা?  নারী কি এই বর্তমান উত্তরোধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাধীন হতে পারে? 
বাস্তববাদী চোখ আর মন এককথায় বলবে- ‘না’। কারণ ভোরবেলায় সংবাদপত্র খুললেই বা টিভি চালু করলেই যেসব চিত্র দেখা যায়, তাতে আর যাই হোক নারীর অবস্থান যে নাজুক, নারী যে পরাধীন তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা মতো অবকাশ পাওয়া যায় না। ঘরে বা বাইরে নারী আজও বিপন্ন। আজও অরক্ষিত। আজও ভোগ্যা। এই সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে নারী এখনো শুধুই জরায়ু।

নারীর প্রতি ওই ধারণা চুরমার করে দিতে হলে নারীকে আয়ত্ত করতে হবে শিক্ষা। গ্রহণ করতে হবে পেশা। তাকে হতে হবে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন, স্বায়ত্বশাসিত। তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য। তাকে মনে রাখতে হবে যে- সে মানুষ, নারী নয়। নারী তার লৈঙ্গিক পরিচয় মাত্র। মনে রাখতে হবে যে, পুরুষের সঙ্গে তার পার্থক্য একটি ক্রোমোসোমের। একটি মাত্র ক্রোমোসোমের জন্য একজন প্রভু ও আরেকজন পরিচারিকা হয়ে উঠতে পারে না।

আর নারীর মর্যাদার প্রশ্নে, শ্রমের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে, নায্য মজুরির প্রশ্নে শুধু একটি দিনের কর্মকাণ্ডকেই স্মরণ রাখলে চলবে না, একটি দিবসের ঘেরাটোপ আর বেগুনী রঙের ঘোর সৃষ্টিই নারী মুক্তির মূলকথা নয়। নারীর জন্য আলাদা রাজ্য বা নারীস্থানের কথাও আমি বলছি না। আমি বলছি, নারীকে মানুষের মর্যাদাটুকু দেওয়া হোক। আর পুরুষের অপজিশন হিসেবে নয়, বৈরিতা তুলে নয়, পুরুষের পাশের চেয়ারটিতেই নারীকে বসতে দেওয়া হোক। নারীও যে মানুষ, তাকে অন্তত এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে উঠতে দেওয়া হোক। 

 

সহায়ক গ্রন্থ:
নারী: হুমায়ুন আজাদ,
ভাবনার ভাস্কর্য: কেতকী কুশারী ডাইসন, 
সিমন দ্য বোভোয়ার, এবং মুশায়েরা: সম্পাদনা, বীতশোক ভট্টাচার্য, সুবল সামন্ত, 
সিমন দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ: অনুবাদ, হুমায়ুন আজাদ

 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়