ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমাদের নীরবতা এবং শঙ্খ ঘোষের বাহাস

আলতাফ শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ২২ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ২১:৫৬, ২২ এপ্রিল ২০২১
আমাদের নীরবতা এবং শঙ্খ ঘোষের বাহাস

‘যে লেখে সে কিছুই বোঝে না
যে বোঝে সে কিছুই লেখে না
দু-জনের দেখা হয় মাঝে মাঝে ছাদের কিনারে
ঝাঁপ দেবে কি না ভাবে অর্থহীনতার পরপারে!’
(‘বোধ’, শঙ্খ ঘোষ)

মাত্র চার পঙ্‌ক্তির এই কবিতাটি বুকে এসে ঘা দিয়েছিল। তখন, সেই আমার কলেজ-পড়ার কালে ভেবেছি, আদতেই কি তাই, যে লেখে সে কি কিছু বোঝে না, আর যে বোঝে সে কি লেখে না কিছুই; এবং ঝাঁপ দিতে দিতে তাদের দুজনের দেখাও হয়ে যায় নাকি অর্থহীনতার পরপারে?
আমার মনে হয়, এই কবিতাটির মধ্যে শঙ্খ ঘোষের কবিতার একটি বড় সূত্রমুখ আছে, আছে সেই ‘বোধ’ যা তাঁকে প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর বছর অব্দি কবিতা লিখতে তাড়িত করেছিল।

শুধু এটুকুই বা বলি কেন, মাত্র এই পঙ্‌ক্তি চর্তুষ্টয়ের মধ্যেই শঙ্খবাবু কি বলে ফেলেননি- যুগ যুগ ধরে বহমান ‘কবিতা’ নামের শিল্পের জন্মের নিগুঢ় কথাটিও? বলেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন নিজের কাব্য-অভিজ্ঞানটুকু।

তা বলে কেউ যেন এমন না ভাবেন, শঙ্খ ঘোষের কবিতার অভিপ্রায় সেই ‘অর্থহীনতার পরপার’। মোটেই তা নয়। সময়ের মধ্যে থেকে, সময় স্পর্শ করে, এবং কবিতায় সময়ের কণ্ঠস্বর ধারণ করেও অদ্ভুত নির্লিপ্তি নিয়ে যে বসত করা যায়, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’র মতো অনড়ও থাকা যায়, তা-ই তো এতকাল নানা ছন্দের কারুকাজে আমাদের দেখিয়ে গেলেন শঙ্খ ঘোষ। শুধু কবিতায় নয়, তাঁর অমৃতসমান গদ্যেও ফিরে আসে এই ‘নিঃশব্দের তর্জনী’। কিন্তু গদ্যবিষয়ক আলাপ এখানে থাক, সে হবে অন্যত্র। অকিঞ্চিৎকর এ লেখায় তাঁর কবিতা বোঝাবুঝির ভেতর দিয়ে বরং উত্থাপন করা যাক একটি জিজ্ঞাসা: শঙ্খ ঘোষ কি চলেই গেলেন?

এই ভূলোক ছেড়ে তিনি চলে গেছেন, জানা কথা। কিন্তু আদতেই গেছেন কি? তাঁকে কি আমরা এখন আরও নিবিড়ভাবে দেখতে পাচ্ছি না বিজ্ঞাপনের রংবাহারের আড়াল থেকে ‘গলির কোণে’? ‘একটা দুটো সহজ কথা’য়?

পঞ্চাশ দশকের এই পরাক্রমী কবিকে দূর থেকে একবারই দেখেছিলাম। দেখা মানে সরাসরি চাক্ষুস আরকি। ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে তিনি বসেছিলেন, আর দূরে দাঁড়িয়ে আমি খুঁজছিলাম তাঁর ‘একলা হওয়া মুখের কথা’। এ বাদে তাঁর সঙ্গে আমার যতটুকু চিনপরিচয়, তা তাঁর লেখা পড়েই। কবির যে কেবল কবিতা লেখাই কাজ, সম্ভবত এটা শঙ্খ ঘোষ বিশ্বাস করতেন না। তাই কবিতায়, গদ্যে বারবার যৌক্তিকভাবে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। আরও আশ্চর্য এই যে, তাঁর সেই প্রতিবাদ কিন্তু ‘জ্বালাও-পোড়াও’ ধরনের নয়, অবশ্যই শব্দের মাধ্যমে প্রতিবাদটি তিনি করেছেন, করেছেন ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ উঁচিয়ে। ওই যে লিখেছিলেন, ‘এত বেশি কথা বল কেন? চুপ করো, শব্দহীন হও... লেখো আয়ু লেখো আয়ু’, স্বেচ্ছায় সেই ‘আয়ু লেখা’র কাজে নিয়ে, লিখতে লিখতে শব্দের ভেতর দিয়ে সত্য তুলে ধরে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। আজীবন এটাই ছিল তাঁর রাজনীতি।

নীরবেও যে তীব্রভাবে রাজনৈতিক থাকা যায়, গলা না উঁচিয়েও যে রাজনৈতিক কবিতা লেখা যায়, এর বড় প্রমাণ শঙ্খ ঘোষ। আধুনিক বাংলা কবিতায় এক্ষেত্রে তিনি হয়তো সেই বিরল ব্যতিক্রমী কবিদের শীর্ষেই থাকবেন। যদিও বলে রাখা ভালো, চুপচাপ তর্জনী নির্দেশ করে শান্ত প্রতিবাদই তাঁর কবিতার একমাত্র প্রবণতা নয়। ‘গন্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’তেই আমরা ভিন্ন এক শঙ্খকে খুঁজে পাব। তবে এটা বেশ বড় গলায় বলা যায়, মিহি শ্লেষ আর প্রতিবাদী চেতনা, এ কবির কবিতাকে জনমানসে তরঙ্গায়িত করেছে, বারবার, বেশি মাত্রায়। ফলে দুই বাংলার জনসংস্কৃতিতে শঙ্খ ঘোষ ওরফে চিত্তপ্রিয় ঘোষের যে ভিত্তি তার মূলে শক্তভাবে রয়েছে তাঁর শান্ত স্বরের প্রতিবাদী কবি সত্তা।

কবিতা লিখেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর কবিতায় যেসব শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হতে দেখি, সেখানে লালিত্যময় শব্দের চেয়ে সমাজে ঘোরাফেরা করা— ‘একটা দুটো সহজ কথা’র মতো চেনা শব্দের সমাহারই অধিক। তো সেই চেনা শব্দগুলো শঙ্খের কবিতায় কীভাবে তলে তলে প্রতিবাদের আবহ তৈরি করে, তার একটা উদহারণ এবার পেশ করা যাক। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থে ‘নচিকেতা’ নামের  কবিতায় কবি লিখছেন:

‘দিয়ে যেতে হবে আজ এই দুই চোখ
ঘ্রাণ শ্রুতি স্পর্শ সব দিয়ে যেতে হবে।
উঠোনে দোপাটি হাওয়া স্মৃতি ও ডালিম
মাঠের পথিক শ্রান্তি দিগন্তদুপুর
কিছু উজ্জীবন কিছু হাহাকার আর
দিয়ে যেতে হবে সব সেতুহীন দিন।
গাভীর শরীরে দ্যুতি অন্ধকার হীরা
দিয়ে যেতে হবে সব বিচালি ও খড়
নিবন্ত মশাল আর ভিটে মাচা ঘর
যা কিছু করেছি আর করিওনি যত
এবার যজ্ঞের শেষে দিতে হবে সব।
এবার নিভৃত এই অপমানে শোকে
যে-কটি অন্তিম জবা উঠেছিল জ্বলে
আগুনে ঝরিয়ে দিতে হবে। আর তোকে
যমের দক্ষিণ হাতে দিতে হবে আজ
চায় তোকে দৃষ্টহীন বধির সমাজ!’

গোটা কবিতাটি প্রচ্ছন্ন শান্ত এবং গভীরভাবে সুনসান। কিন্তু আড়ালে-গোপনে গেরিলার মতো সরব। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে ‘চায় তোকে দৃষ্টহীন বধির সমাজ’ বাক্যটি লিখেই কবি খান্ত হননি, তার পাশে জুড়ে দিয়েছেন একটি বিস্ময়বোধক চিহ্ন। সব মিলিয়ে এ কবিতায় কবির নীরব প্রতিবাদটি ওই বিস্ময় চিহ্নের করণে শান্ত ভাবের ভেতরেও বোধ করি পেয়ে যায় এক ফোঁটা শ্লেষের পাটাতন। তাই প্রতিবাদটি নিজের শান্ত ভঙ্গিমা জারি রেখেও একটুও কমজোর কিন্তু নয়। কেন না, নানান রকম ‘যমের দক্ষিণ হাতে’ নিজেদের সপে দিয়েই তো আমরা আজকাল ‘দৃষ্টহীন বধির সমাজ’-এর বেশ একটা ‘সামাজিক’ হচ্ছি।

এ ছাড়া, এ কবিতা লেখার সময়টিও স্মরণে রাখা ভালো। জানা যাচ্ছে, গত শতকের সত্তরের দশকে ভারতে ইন্দিরাকৃত যে জরুরি অবস্থা জারি হয়, সে-সময় বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সেগুলোর অধিকাংশই গ্রন্থিত হয়েছে তাঁর ‘বাবরের প্রার্থনা’ ও ‘বন্ধুরা মাতি তরজায়’ গ্রন্থে। তো, এখন কেউ যদি ‘বাবরের প্রার্থনা’র এই শেষ কবিতাটির সঙ্গে সেই মধ্য সত্তরের ঝঞ্জামুখর বাস্তবতাটি একটু মিলিয়ে পাঠ করেন, সহজেই এটি অন্য রকম আচ্ছন্নতা ও উদ্ভাসে ধরা দেবে।

এমনভাবে শুধু একটি কবিতা নয়, এন্তার উদাহরণ সামিল করা যাবে, যেখানে পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে শঙ্খের প্রতিবাদ দাঁড়িয়ে আছে ‘ছাদের কিনারে’। পাঠক হিসেবে মাঝে মাঝে  তার সঙ্গে আমাদের দেখা হলে, আমরা বুঝে নিতে চাই এর রূপ-রস-গন্ধ। তবে তাঁর কবিতার সেসব চরণ দিয়ে আমরা কি ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’-এর মতো বাজারচলতি শ্লোগান গড়ে নিতে পারি?

না, তা-ও খুব একটা পারি না। কারণ, পুঁজির তীব্র জৌলুশে আজ যখন আমাদের ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ তখন, নীরবে, গভীরে শঙ্খ-চরণগুলো শ্লোগানের চেয়ে বেশিভাবে আমাদের কাছে হয়ে ওঠে ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’। অতঃপর কখনো প্রতিবাদ, কখোনো-বা শ্লেষে সেগুলো আমাদের শরীর বিদ্ধ করে এবং বলে, ‘এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন/শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে!’ শঙ্খবাবু বর্মহীন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে নিজেদের ক্ষত-পাছড়া-পুঁজ দেখিয়েও দেন বটে শান্ত ঘা দিয়ে। এক্ষেত্রে ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ আরেকটি উদহারণ মাত্র:

‘ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?
চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?
মনে হয় ফিরে এসে স্নান করে ধূপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠুরিতে
বসে থাকি?

মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই
মানব শরীর একাকার?

দ্রাবিড় সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা, তার
ভেসে ওঠা ভেলাজুড়ে অনন্তশয়ন লাগে ভালো?

যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো। চতুরতা, যাও।
কী-বা আসে যায়

লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বলবে সামাজিক নয়!’

অতএব জন্মসূত্রে বাংলাদেশে নাড়িপোঁতা শঙ্খ ঘোষের কবিতা একইসঙ্গে আমাদের আত্ম-উন্মোচনের কাতারেও দাঁড় করায়; এবং নিজস্ব ক্লেদ উন্মোচন শেষে কেমন যেন একটা বিমোক্ষণ ঘটে পাঠকের, খানিকটা শান্তিও পাই আমরা।

আজ আমাদের দেশে এবং স্বারস্বত সমাজে যখন ঘোর নীরবতার কাল, যখন নিজেদের মধ্যে চলছে সেলফ সেন্সরশীপ, ধর্ম নয় যখন আস্ফালন করছে ধর্মান্ধতা, তখন ‘গোধূলি সন্ধির’ এই অস্থির সময়ে শঙ্খবাবু তো আমাদের সহায়। তিনি আমাদের জন্য  হতে পারেন কার্যকর উপশমও।

মৃত্যুতে তাঁর শেষ হবে না, বরং ‘বোধ’-এর কিনারে দাঁড়িয়ে, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ উঁচিয়ে আমাদের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষ কথা কইতেই থাকবেন। আমাদের ভালো লাগুক কি না-ই লাগুক, যখনই প্রয়োজন হবে, তিনি বারবারই বাহাস করতে থাকবেন আমাদের সম্মিলিত নীরবতার বিরুদ্ধে।


 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়