ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আমার মা ও মাতৃদিবস

আনোয়ারা সৈয়দ হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ৯ মে ২০২১   আপডেট: ১৪:২০, ৯ মে ২০২১
আমার মা ও মাতৃদিবস

রাত গভীর। দূরে মাঝে মাঝেই শেঁয়াল ডাকছে। অন্ধকার মফস্বল শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের বালিকা আমি। কিন্তু আমি নিবিষ্টমনা পড়ুয়া। যত রাত হোক, পড়া শেষ না করে উঠতে রাজি নই। এদিকে আবার অন্ধকার ভয় পাই, শেয়াল ভয় পাই, ভূত ভয় পাই, রাতের আঁধারে হ্যারিকেনের আলো বেশি দূর যেতে পারে না, অথচ সেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাতের পড়া করতে হয়। আমাকে এই রাতের বেলা পাহারা দেবে কে?

কেন, আমার মা। আমার মা আমাকে রাতের পর রাত খোলা বারান্দায় একটু দূরে অন্ধকারে বসে আমাকে পাহারা দিচ্ছেন!

যতক্ষণ আমার পড়া চলবে, মা বসে অপেক্ষা করবেন।

মাঝে মাঝে নিঃশব্দতার ভেতরে ঠাওর পেতাম না যে মা বসে আছেন কিনা, তাই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই হাঁক দিয়ে উঠতাম- মা?

আর মা বলতেন, এই তো আমি!

না, আমার মায়ের আমিই একমাত্র সন্তান ছিলাম না, আমি বাদে তখন তাঁর আরও পাঁচটি সন্তান ছিল। এবং তিনি তখন আবারও গর্ভবতী। কিন্তু সেই ছেলেবেলায় সেদিকে আমার কোনো খেয়াল ছিল না। আমি শুধু আমাকে নিয়েই ছিলাম ব্যস্ত। মনে মনে ভাবতাম এই মা বুঝি শুধু আমারই মা, শুধু যেন আমার ভালোমন্দের সঙ্গেই তিনি জড়িত। এর মধ্যে আর কারও ভাগ নেই! আমার আর কোনো ভাইবোন আমার আর আমার মার সম্পর্কের ভেতরে ভাগ বসাতে পারবে না!

আশ্চর্যের ব্যাপার, বড় হয়ে, জীবন চিনে, জীবনের পথ বেয়ে চলতে চলতে জেনেছি, আমার সব ভাইবোনেরাই আমাদের এই শত ভাগ করা মাটিকে শুধু তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত মা বলেই জানত। এবং ভাবত মা বুঝি তাকেই বেশি ভালোবাসেন!

এখন মাঝে মাঝে তাই ভাবি, আমার মা তো কোনো ডিপ্লোম্যাট ছিলেন না। সাধারণ অল্পশিক্ষিত একজন মা ছিলেন মাত্র, সেই মা কীভাবে তাঁর ছেলেমেয়েদের ভেতরে এই ধারণা দিয়ে গেলেন যে মা তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন!

এ জন্য আমাদের শতভাগ করা মা কেবল আমাদের ব্যক্তিগত মা হয়ে আমাদের মনের গভীরে স্থান করে নেন। কারণ প্রতিটি সন্তানের সঙ্গে একজন মায়ের ইউনিক একটি সম্পর্ক। এই সম্পর্ক মনের অতলে এমন এক গভীরে প্রবিষ্ট হয়ে যায় যে, প্রতিটি সন্তানই মনে করে তার মা শুধু তার নিজেরই মা। তার নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে যিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেখানে তার ভাইবোন হয়ে যায় গৌন।

এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। বরং বাবাকে আমরা সবাই ভাগ করে নিতে পারি। একজন বাবা আমাদের সবার বাবা। আর তাতেই আমরা খুশি। কিন্তু মাকে ভাগ করতে পারিনে। আমাদের প্রত্যেকের মা হচ্ছেন এক ও অনন্য। এর কোনো ভাগ নেই। এর কোনো ভাগ হয় না। তাহলে কি আমরা যখন মায়ের গর্ভে ঘুরপাক খাই ন’টি মাস, তখন থেকেই কি মায়ের সঙ্গে আমাদের একটি অতি বিশ্বস্ত ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্ক শুরু হয়ে যায়? এবং কালে কালে তা আরও প্রগাঢ় একটি বন্ধনে পরিণত হয়? এবং পরবর্তী জীবনে আমরা যে ভাইবোনদের ভালোবাসি তার মূল কারণ যেহেতু আমার মায়ের গর্ভেই তারা স্থান লাভ করেছে বলে?

এসব নিয়ে ভাবতে গেলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তবু ভাবি। আর যত ভাবি, তত মা আমার যেন আরও কাছে চলে আসেন।

মাঝে মাঝে আমার ভেতরে প্রচণ্ড একটি অপরাধবোধ জেগে ওঠে, আর তা হলো আমি আমার মাকে আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কোনো প্রতিদান দিতে পারলাম কিনা?

না, দিতে পারিনি। যদিও জানি প্রতিদান দিয়ে মায়ের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যায় না, তবু সাদামাটাভাবেও বলতে পারি, না কোনোদিন প্রতিদান দিতে পারিনি। বড় হয়ে জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে বরং যখন মায়ের কাছে গেছি, উল্টে বরং মা-ই আমাকে সান্ত্বনার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মায়ের ওপরে অনেক অযথাই রাগ করেছি। মা কেন আমার যুক্তি বোঝেন না তা নিয়ে অনেক অসহিষ্ণু ভাব প্রকাশ করেছি, কিন্তু মা আমাকে একবারেরও জন্যও তিরস্কার করেন নি।

বরং মা যখন ক্যানসার রোগে আক্রান্ত, আর এই সহায়সম্বলহীন নিষ্ঠুর রাজধানী শহরে আমি পাগলের মতো এখানে সেখানে আশ্রয়প্রার্থী, কারণ মাকে ঢাকায় টেনে এনেছি চিকিৎসা করবার জন্য, তখন মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রাতের গভীরে বলে উঠেছেন- আমি চলে গেলে তোমরা খবরদার মাতম করবে না! আমি চাই না, আমার জন্যে আমার ছেলেমেয়েরা কোনো কষ্ট পাক। আনন্দে থাকবে। হাসিখুশি থাকবে। মিলেমিশে থাকবে!

হায়, আমার মা!

ক্যানসারের কষ্ট সহ্য করতে করতে মা চলে গেলেন।

অনন্তের আহ্বানে মা আমাদের চলে গেলেন।

কিন্তু আমরা হাসিখুশি থাকতে পারলাম না।

কীভাবে হাসিখুশি থাকব? ছোট ছোট ভাইবোন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। অস্থির একটা দেশ। জাতির পিতা নিহত। স্বৈরতন্ত্র এসে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত। লেখক হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন। লেখক স্বামীকে সাহায্য করা। সংগ্রাম। শুধু সংগ্রাম। এতসব নিয়ে কীভাবে মানুষ হাসিখুশি থাকবে?

কিন্তু না, আমাদের মা বলে গেছেন, হাসি খুশি থাকবে। তাই আমরা ভাইবোনেরা যে যেখানে, সংগ্রাম করে, পরিশ্রম করে, দেশে-বিদেশে , হাসিখুশি আছি। সারাজীবন হাসিখুশি থাকব। কারণ আমরা জানি, আমরা হাসিখুশি থাকলেই আমাদের মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।

আমি বা আমরা জানি, আমাদের এই একটি মা, মূলত আমাদের বাংলাদেশেরই মা। কখনো শিক্ষিত, কখনো-বা অর্ধশিক্ষিত, কখনো বা অশিক্ষিত মা। কিন্তু এতে কিছুই এসে যায় না। কারণ আমাদের সকলেই মা-ই হচ্ছেন জ্ঞানী। সহনশীলতার পরিমাপে সর্বংসহা। ভালোবাসা এবং মানবতার ব্যাপারে সর্বদাই অগ্রসর। করুণায় সাগরতুল্য। এই আমাদের বাংলাদেশের মা।
এবং এই মা-ই আমাদের সমগ্র জগতে পরিব্যপ্ত।

আজ এই মা দিবসে আমরা তাই সবাই করজোড়ে বলি, আমার মা যেমন আমাদের সকলের, তেমনি অন্য সকলের মাও আমাদেরই মা। পৃথিবীজুড়ো একটি শব্দই আকাশে বাতাসে ভাসে- মা, মা, মা। পৃথিবীর সর্বাধিক উচ্চারিত যে শব্দ তা হলো- মা।

৮ মে, ২১

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়