ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সাদত হাসান মান্টো : আমার আব্বু

দিলওয়ার হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৪, ২১ মে ২০২১   আপডেট: ১৬:২১, ২১ মে ২০২১
সাদত হাসান মান্টো : আমার আব্বু

(উপমহাদেশের খ্যাতনামা লেখক, সবচেয়ে পঠিত এবং বিতর্কিত সাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর জন্মবার্ষিকী ছিল গত ১১ মে। ১৯১২ সালের এই দিনে তিনি পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার সাম্বরালায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা গুলাম হাসান ছিলেন সাবজজ। তাঁরা কাশ্মীরী মুসলমান। তাঁর মায়ের নাম সর্দার বেগম বা ছোটি বেগম। 
১৯৩৪ সালে মান্টোর প্রথম লেখা অমৃতসরের সাপ্তাহিক ‘খল্ক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রথম গল্প সংকলন ‘আতিশপারে’  বের হয় ১৯৩৬ সালে। নানা ভাষার বই পড়ে মান্টো সাহিত্য বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। মুক্তচিন্তার লেখক ও  সাংবাদিক আবদুল বারি আলিগের সান্নিধ্যে এসে তিনি ভিক্তর হুগো, গোরকি, চেখভ, পুশকিন, অস্কার ওয়াইল্ড ও মোপাসাঁ-সহ অনেক লেখকের রচনা পাঠ করেন। অনুবাদ করেন হুগোর ‘দ্য লাস্ট ডেজ অব কনডেমড ম্যান’ এবং অস্কার ওয়াইল্ডের ‘ভেরা’।

অমৃতসরের দৈনিক মুসাবাত পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে মান্টো কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এরপর  থেকে তিনি নানান ধরনের কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। যেমন: সাংবাদিকতা, পত্রিকা সম্পাদনা, অনুবাদ, চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনা ইত্যাদি। অসংখ্য গল্প  ছাড়াও তিনি লিখেছেন উপন্যাস, স্মৃতিকথা, বেতার নাটক ও নিবন্ধ। মির্জা গালিবকে নিয়ে রচিত তাঁর চিত্রনাট্য বিশেষ প্রশংসা লাভ করে।

প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে মান্টো সমাজের অন্ধকার দিকগুলোর ওপর তীব্র আলো ফেলে সেখানকার অসঙ্গতিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ইসমত চুঘতাইয়ের ভাষায়: ‘মান্টো সমাজের দলিত, নিষ্পেষিত ও আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেওয়া মানুষের মধ্যে থেকে মোতি তুলে নিয়ে নিখুঁতভাবে সাজিয়েছেন।’ আলি সর্দার জাফরি বলেছেন: ‘মান্টোর দক্ষতা তাঁর কলমের ডগায় রত্নের মতো জ্বলজ্বল করছে।’ যার প্রমাণ আছে: খুশিয়া, ব্লাউজ, কালি সালোয়ার, বু, নঙ্গী আওয়াজেঁ, তোবাটেক সিং, টিথওয়াল কা কুত্তা, নয়া কানুন, শহীদে সাজ, হতক, খুল দো, বাবু গোপীনাথ, ঠান্ডা গোস্ত, নারা, প্রগতিশীলসহ আরো অনেক গল্পে।

তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছে, মামলা হয়েছে আদালতে। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। প্রবল মদ্যপান ও হতাশায় আক্রান্ত হওয়ায় দুবার তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এত কিছুর পরও মান্টো একজন মহান লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। দেশ বিভাগের পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব মান্টোকে হতবিহ্বল করে তোলে। মনের মধ্যে প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে তিনি লাহোর চলে যান, যেখানে তিনি উপযুক্ত মর্যাদা লাভ করতে পারেননি। জীবন অতিবাহিত হয় চরম দারিদ্র্য আর হতাশায়। ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি পার্থিব পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। রেখে যান স্ত্রী সাফিয়া বেগম আর তিন নাবালিকা কন্যা: নিঘাত, নুজহাত ও নুসরাতকে।

২০১২ সালে মান্টোর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ওই তিন বোন ভারত সফরের মাধ্যমে নিজেদের জন্মস্হান ও পিতার আদি ভিটেমাটি পরিদর্শন করেন। তাঁর  মেজ মেয়ে নুসরাত আরশাদ বাবাকে নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ স্মৃতিকথা রচনা করেন, যেটি প্রকাশিত হয় ‘মান্টো সাহেব ফ্রেন্ডস্ অ্যান্ড এনিমিস্ অন দ্য গ্রেট ম্যাভারিক্’ গ্রন্থে। অনুবাদ: ড. বিভা এস. চৌহান ও ড. খালিদ আলভি। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।)

আব্বু ইন্তেকাল করেন ১৯৫৫ সালে। তখন আমার বয়স ৭, বড় বোনের ৯ আর ছোট বোনের ৫। এ কারণে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমাদের ছিল না, ছিল না তাঁকে  বোঝার মতো বা স্মরণে রাখার মতো বয়স।

আমাদের মধ্যে কেউই পড়া ও লেখালেখিতে আগ্রহী ছিলাম না যা থেকে আম্মিজান একটুখানি সান্ত্বনা বা সন্তুষ্টি লাভ করতে পারতেন। একটা বিষয়ে তাঁর মতামত ছিল স্পষ্ট ও পরিষ্কার: কারও লেখালেখিতে না-আসাই উচিত। লেখকের স্ত্রী হিসেবে আম্মিজানের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। আব্বুর অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাস তিনি কোনো ক্রমেই মেনে নিতে পারেননি।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, আব্বু ছিলেন অতিরিক্ত রকমের দয়ালু ও ভদ্র। এক কথায় তিনি তাঁর যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারতেন। টাঙ্গাওয়ালার কাছে একশ টাকার নোটের ভাংতি না-থাকলে সেটা অবলীলায় তাকে  দিয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না। হেলাফেলা করে এ ভাবে টাকা নষ্ট করার স্বভাব ত্যাগ করতে আম্মিজান তাঁর কাছে বহু অনুযোগ অভিযোগ করেছেন; বিশেষ করে সেই সময়গুলোতে যখন সংসার চালানোর মতো কোনো টাকাই তাঁর হাতে থাকত না।

দরিদ্র মানুষের জন্যে আব্বুর ছিল অসীম ভালোবাসা ও সহানুভূতি। আমাদের ভেতর যে সামান্য পরিমাণ দয়ামায়া ছিল তা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলাম।একবার একজন ভারতীয় লেখক আমাদের লাহোরের বাড়িতে এসে হাজির হন। জানান, তিনি মান্টো সাহেবের অপ্রকাশিত  রচনাবলীর একটি সংকলন বের করতে চান। আমরা আব্বুর লেখা সব গল্প তার হাতে তুলে দেই। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই, অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি মূল পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেননি। ওগুলো হাতে পেয়ে তিনি একেবারে হাওয়া করে দেন। আব্বুর মৃত্যুর পর তাঁর অনেকগুলো গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। কিন্তু আম্মিজান একটি টাকাও পাননি, পাননি কোনো রয়ালটি। টাকা-পয়সার অভাব ও দুশ্চিন্তার মধ্যে তাঁকে দিন গুজরান করতে হয়েছে। তারপরও আমাদের সুশিক্ষা ও সৎপাত্রে পাত্রস্থ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিনি।

জীবনভর তিনি যে সব সমস্যা মোকাবিলা করেছেন তার কথা কী করে ভুলে যাই! সেই সব কষ্টকর দিনগুলোতে আম্মিজানের ভাই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আর প্রসারিত করেছেন সহযোগিতার হাত। তাঁর ওই সহযোগিতার কারণে আব্বুর মৃত্যুর পর আমরা নিজেদের এতিম ভাবতে পারিনি।

স্ত্রী সাফিয়ার সঙ্গে মান্টো

আম্মিজান আমাদের বলে গেছেন, কী করে আব্বু শেষ জীবনে এসে প্রচণ্ড মদাসক্ত হয়ে পড়েন আর নিজের একেকটা গল্প পাঁচ কিংবা দশ টাকায় বিক্রি করে দেন। দেশ ভাগের পর তিনি বোম্বে ছেড়ে লাহোর চলে আসেন, কিন্তু বোম্বেতে তিনি যে উচ্চ আসনে সমাসীন ছিলেন, লাহোরের সাহিত্যাঙ্গনে তিনি সেই অবস্থান ও মর্যাদা লাভ করতে পারেননি। মান্টো সাহেব একজন অশ্লীল লেখক এই প্রচারণার কারণে জীবনের শেষ ১০ বছর তাঁর লেখার জনপ্রিয়তা কমে যায়।

সরকারের নীতিমালার কারণেও তাঁর লেখার জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে মান্টো সাহেবের অনেক গল্পের নাট্যরূপ পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়। এইসব নাটক বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও পরে আর সেগুলো দেখানো হতো না।

লাহোরে আসার পর আব্বু সিনেমার জন্যে তেমন কিছু লেখেননি। তাঁর রচিত গল্প ‘কাতারি’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র সাফল্যের মুখ দেখে। একটা পুরস্কারও পেয়েছিল সিনেমাটি। তাঁর লেখা কাহিনি অবলম্বনে বানানো সিনেমা ‘এক গুনাহ আওর সাহি’ও পুরস্কার পায়। এই সিনেমাতে আমাদের আম্মিজানের ব্যক্তিত্ব পরিস্ফূটিত করে তোলা হয়েছিল। এই কাহিনির জন্যে প্রযোজক পাঁচশ টাকা দিয়েছিলেন। প্রকাশকদের মতো প্রযোজকরাও কাহিনিকার বা লেখকদের টাকা দিতে চাইতেন না।

আম্মিজানই ছিলেন আব্বুর যে কোনো লেখার প্রথম পাঠক। তিনি তাঁর প্রচণ্ড মেধার কথা আমাদের বলতেন। একটা সময় ছিল যখন তিনি একসঙ্গে তিনটি লেখা ভিন্ন ভিন্ন  তিনজনকে ডিকটেশন দিতে পারতেন। বাড়িতে আগত অতিথিদের সঙ্গে গল্প করতে-করতে লিখে ফেলতেন নিজের লেখা।
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়