ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রসরচনা || অজ্ঞতাই সকল সুখের মূল

রাজীব সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ৬ অক্টোবর ২০২১  
রসরচনা || অজ্ঞতাই সকল সুখের মূল

অলঙ্করণ: কাউছার মাহমুদ

গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘Know thyself’— অর্থাৎ নিজেকে জানো। আর এ কথা যুগ যুগ ধরে আপ্তবাক্যের মতো মানবজাতি উচ্চারণ করে এসেছে যে ‘Knowledge is power.’ নিজেকে অথবা অপরকে জানা তথা জ্ঞান অর্জন বরাবরই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে মহাপুরুষ ও মনীষীদের কথায়। ছোটবেলায় সবাই পড়েছি, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যাও’, ‘কলম তরবারীর চেয়ে শক্তিশালী’— এ জাতীয় বাক্য জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথাই তুলে ধরেছে।

কিন্তু জ্ঞান কি মানুষকে সুখী করতে পেরেছে? যাদের জ্ঞান নেই তারা কি অসুখী? চারপাশে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যাদের জ্ঞান নেই অর্থাৎ যারা অজ্ঞ তাদের চেয়ে সুখী কেউ নেই। হীরক রাজার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। তার বিখ্যাত বচন: ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।’ অজ্ঞতার অনুরাগী হীরক রাজা যে সুখী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্কুলজীবনে পাঠ্যপুস্তকে একটি গল্প পড়েছিলাম। এক মোড়লের কঠিন অসুখ হয়েছে। কোনো বৈদ্য কবিরাজ তাকে সারিয়ে তুলতে পারছে না। মৃত্যু যন্ত্রণায় মোড়ল ছটফট করছেন। তখন ভিন দেশ থেকে আগত এক চিকিৎসক বললেন, যদি কোনো সুখী মানুষের জামা এনে মোড়লকে পরানো যায় তার অসুখ সেরে যাবে। দিগ্বিদিক লোক ছুটে গেল সুখী মানুষের খোঁজে। কিন্তু চেনা অচেনা কোনো মানুষ নিজেকে সুখী বলে স্বীকার করলো না। অবশেষে এক নিরক্ষর, দরিদ্র লোককে পাওয়া গেল যিনি নিজেকে সুখী বলে দাবি করলেন। মোড়লের অনুচররা যখন তার জামাটি চাইলো তখন নিঃস্ব লোকটি বললো— তার কোনো জামা নেই।

থাকবে কী করে, জামা কেনার সামর্থ্যই তার নেই। প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করা লোকটি ছিল সহজ সরল অজ্ঞ প্রকৃতির। বিত্ত, বৈভব, জগতের ভালো-মন্দ কোনো কিছু সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। কোনো দুশ্চিন্তাও তাকে গ্রাস করেনি। তাই তিনি ছিলেন সুখী মানুষ।

বর্তমান যুগে সুখ যতটা না অনুভবের, এর চেয়ে বেশি প্রদর্শনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সুখ প্রদর্শনের ঊর্বরভূমি। শাড়ি, গাড়ি, নারী, গহনা নানা ইস্যুতে সুখের ছড়াছড়ি। হাসি হাসি মুখে দম্পতির ছবি, উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া বন্ধু-বান্ধবীর ছবি, মেকি শব্দ-বাক্যে বানানো সুখী স্ট্যাটাস— অর্থহীন সুখের পৃথিবী। সবার সুখের অভিনয়। আইয়ুব বাচ্চুর গানের ভাষায় বলতে হয়— আসলে কেউ সুখী নয়। ফেইসবুকে জ্বলজ্বল করতে থাকা মানুষগুলো কি সুখী? আত্মপ্রশংসা, পরচর্চা, পরনিন্দা, রুচিহীনতার প্রতিযোগিতায় মত্ত এই মানুষগুলোর ব্যক্তিগত জীবন ঘাঁটলে সুখের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। যে ব্যক্তি তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানে অজ্ঞ, ফেইসবুক, টুইটারে যার প্রবেশাধিকার নেই, সেই সাধারণ মানব বা মানবী হয়তো সবচেয়ে সুখে আছে। ডিজিটাল কলহ, বিবাদ, সংকীর্ণতা তাদের স্পর্শ করে না।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। নায়িকা পরীমনি ইস্যুতে দীর্ঘদিন সরগরম ছিল সোশ্যাল মিডিয়া। পরীমনির পক্ষে ও বিপক্ষে অগণিত ব্যক্তি সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে। এই যুদ্ধ নিছক শব্দ বিনিময়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। সভ্যতা, ভব্যতার সীমা পেরিয়ে কুরুচি ও অশ্লীলতার জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল দুপক্ষের বক্তব্য। প্রতিপক্ষের প্রতি বাক্যবাণ ছুঁড়তে গিয়ে অনেকেই ধৈর্য হারিয়েছেন, ঘর্মাক্ত হয়েছেন। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে নিজেদের ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। এদের প্রায় সবাই পরীমনির অপরিচিত। তবুও তার জন্য নিজেদের প্রচুর ক্যালরি ক্ষয় করেছেন বীরপুঙ্গবের দল। অথচ যে মানুষটি পরীমণিকে চেনে না, জানে না সে এই হাস্যকর লড়াইয়ে অংশ নেয়নি। পরীমনির জামিন হলো কি হলো না, পরীমনি অপরাধী কিনা এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এ রকম অকারণ ইস্যুতে যাদের মাথাব্যথা নেই তাদের চেয়ে সুখী কি কেউ আছে?

যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিই অনুভব করেন যে শৈশব হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ‘শিশুসুলভ সারল্য’ বলে একটি প্রচলিত কথা আছে। এই সারল্যের মূল নিহিত শিশুর অজ্ঞতায়। শিশু যা খুশি বলতে পারে, যা খুশি করতে পারে। বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যেতে পারে। এটিই শিশুর শিশুত্ব। তাদের কারো কিছু বলার নেই। শিশুত্ব অতিক্রম করে যত আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় দিকে এগোতে থাকি, তত আমাদের অজ্ঞতা দূর হতে থাকে। অর্থাৎ আমাদের জীবনে নানা ঝামেলা ও সংকট দানা বাঁধতে থাকে। শৈশবের অন্তহীন স্বাধীনতার কথা মনে করে বহু প্রবীণ স্মৃতির জাবর কেটে উচ্চারণ করেন— ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!’

জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলেন, ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।’ প্রলয় যদি ঘটেও তাতে কি অন্ধ ব্যক্তির কিছু যায় আসে? প্রলয়ের ধ্বংস তো তাকে দেখতে হচ্ছে না। অজ্ঞ ব্যক্তিরও এই সুবিধা রয়েছে। মাথা নেই, তাই মাথাব্যথাও নেই। ‘ষোল আনা মিছে’ কবিতাটি নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। এক পণ্ডিত ব্যক্তি নৌকা দিয়ে নদী পার হচ্ছেন। মাঝিকে তিনি নানা প্রশ্ন করেছেন। সূর্য কেন ওঠে, চাঁদ কেন বাড়ে কমে, জোয়ার কেন আসে, আকাশ কেন নীল, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ কেন হয় ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞ মাঝি দিতে পারে না। পণ্ডিতমশাই ভর্ৎসনা করে মাঝিকে বলেন যে তার জীবনটা বারো আনাই মিছে। নিজের অজ্ঞতার কারণে লজ্জিত হয় মাঝি। একটু পরে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। নৌকা দুলতে শুরু করে। সাঁতার না জানায় পণ্ডিত প্রচণ্ড ভয় পান। এবার মাঝির মুখে কথা ফোটে। পণ্ডিতকে বলে যে— তার জীবন তো ষোল আনাই মিছে।

‘সাক্ষীগোপাল’ নামে একটি জনপ্রিয় বাগধারা আছে বাংলা ভাষায়। এর অর্থ নীরব দর্শক। সাক্ষী গোপালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া মানুষের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নয়। কোনো অসঙ্গতি, অনিয়ম চোখে পড়লে তারা চোখ বন্ধ করে থাকেন। এমনকি দায়িত্ব পালন করার কথা যাদের, তাদের মধ্যেও অদ্ভুত নির্লিপ্ততা দেখা যায়। যেন তারা কিছুই জানেন না, কিছুই বোঝেন না। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও কখনো কখনো অজ্ঞ সাজার প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কেন তারা অজ্ঞতার মোড়কে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন? এটি তারা করেন নিজেদের সুবিধার জন্য। সমাজের নানা স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে বলেন ‘নো কমেন্টস।’ এই কথাটির মানে কী? তিনি মন্তব্য করতে চান না বা তিনি কিছু জানেন না। হয়তো বিষয়টি এমন স্পর্শকাতর যে না জানা অর্থাৎ অজ্ঞতাই সবচেয়ে নিরাপদ। অজ্ঞতার এই সুবিধা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্ত সেন। তাঁর একটি বিখ্যাত ভক্তি গীতিকায় লিখেছেন: ‘আমি দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু/ দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।’ 

কিছু না দেখা, না জানা, না বোঝার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই, বরং দায়মুক্তির সুখ আছে। শিক্ষিত, সচেতন ব্যক্তি কখনো কখনো কাণ্ডজ্ঞান থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আবার অজ্ঞ ব্যক্তি কাণ্ডজ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন। এ সম্পর্কিত একটি গল্প বলে এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি। 

সেই পণ্ডিত বিশেষ প্রয়োজনে রাতের বেলা একটি ঝোঁপের দিকে যাচ্ছিলেন। গ্রামের লোকজন তাঁকে ওখানে যেতে নিষেধ করল, কারণ সেখানে প্রায়ই বাঘ আক্রমণ করে। পণ্ডিত বললেন, ‘বাঘ আবার কি? মানে ব্যাঘ্র তো? ব্যাঘ্র শব্দ তৈরি হয়েছে ‘বি’ উপসর্গ আর ‘আ’ উপসর্গের পর ‘ঘ্রা’ ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ প্রত্যয় যোগ করে। (বি-আ-ঘ্রা+অ)। ‘ঘ্রা’ ধাতুর অর্থ ‘ঘ্রাণ নেয়া’। তাই ‘ব্যাঘ্র’ মানে ‘যে বিশেষ করে ঘ্রাণ নেয়’। ওই ব্যাঘ্র আমাকে কী করবে?’ 

এই সাহসে ভর করে পণ্ডিত ঝোঁপের ভেতর ঢুকলেন। হঠাৎ এক ব্যাঘ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। চিৎকার করে পণ্ডিত বললেন, ‘ওহে ব্যাঘ্র এ তুমি কী করছো? তোমার তো কেবল ঘ্রাণ নেওয়ার কথা, ভক্ষণ করছো কেন আমাকে? তুমি তো পানিণির ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন করছো?’

ব্যাঘ্র পানিণির নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পণ্ডিতের শুধু ঘ্রাণ নয়, প্রাণ নিয়ে ছাড়ল।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়