ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আমাদের পরস্পরকে আবিষ্কারের চেষ্টা থেমে থাকেনি

জুয়েল আইচ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৯, ১৩ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৯:০৮, ১৩ নভেম্বর ২০২১
আমাদের পরস্পরকে আবিষ্কারের চেষ্টা থেমে থাকেনি

হ‌ুমায়ূন আহমেদের আলোকচিত্র : নাসির আলী মামুন

ম্যাজিকের প্রতি অসম্ভব দুর্বলতা ছিল হ‌ুমায়ূন আহমেদের। তিনি সুটকেস ভর্তি করে বই কিনতেন। যার মধ্যে থাকত ম্যাজিকের বই। ‘হিস্ট্রি অব ম্যাজিক’, ‘ম্যাজিক ডিকশনারি’র মতো অসংখ্য বই তার মুখস্থ ছিল। সেগুলো নিয়ে কথা বলতেন। আমি তার আগ্রহ দেখে অবাক হতাম! আমার অবাক হবার বিস্তৃতি বেড়েছে বই কমেনি।

বিষয়টি বলতে আমি সংকোচ বোধ করি, একবার ভরা মজলিশে আমার সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘জুয়েল আইচের দুর্ভাগ্য তার জন্ম এদেশে হয়েছে। সে পাশ্চাত্যের কোনো দেশে জন্মালে তার অবস্থান অন্যরকম হতো। কিংবা আমাদের দুর্ভাগ্য জুয়েল আইচকে আমরা তুলে ধরতে পারিনি।’
সেদিনের ঘটনা আমাকে অবাক করে দিয়েছিল।

এই নন্দিত কথাসাহিত্যিক আমাকে একটি বই উৎসর্গ করলেন ‘ম্যাজিক মুনশি’। বইটির উৎসর্গপত্রে লিখলেন: ‘জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্টজয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন। ইনি নামতে ভুলে গেছেন।’ শুরুতে আমি জানতাম না তিনি এ কাণ্ডটি করেছেন বা করতে পারেন! একদিন আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারি। পাঠক সাধারণত লেখকের স্বাক্ষর চায়। কিন্তু একটি মেয়ে বইটি এনে উৎসর্গপত্রের পাশে আমার কাছে আমার স্বাক্ষর চাইলো। আমি তখনই প্রথম বিষয়টি জানতে পারি। বিষয়টি খুবই আনন্দের এবং ঘটনাটি সম্ভবত বিরল।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয়, জানা-শোনা, দেখা হওয়া কখনো প্রত্যক্ষ, কখনও-বা পরোক্ষ। আমরা তখন দুজনেই তারুণ্যে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে তখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার ঘর ছিল না, কাপড় ছিল না- ছিল শুধু আশা, বাঁশি এবং এই সময়েই আমি ম্যাজিক ধরলাম হৃদয়ের সমস্ত জোর অবলম্বন করে। আমার পরিচিতি তৈরি হতে থাকলো। বরিশালের একটি মেয়ে একখানা বই উপহার দিলো- তোমাদের জন্য ভালোবাসা। বইটির লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদ। বইটি পেয়ে ভেবেছিলাম প্রেমের উপন্যাস। কিন্তু সেটি ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। পরপর তার আরও দুটি বই পড়লাম ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’। পড়ে মনে হলো- তিনিই আসল জাদুকর! জাদুতে আচ্ছন্ন করে রাখেন। 

একদিন মুখোমুখি হলাম হ‌ুমায়ূন আহমেদের। তাঁর ছবি সংবলিত একটি বাণী: ‘পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই, যা না করলে মানুষের জীবন ব্যর্থ হয়, জীবন এতই বড় ব্যাপার যে, একে ব্যর্থ করা খুবই কঠিন’ পড়ে চমকে গেলাম। মন বললো- এতো আমারই কথা। দুই হাত তুলে ওই ছবিতে তার গালে আদর বুলিয়ে দিলাম। আমার সেই হাত দুটি নামিয়ে নিজের বুকে চেপে রাখলাম।   

এরপর আমাদের সরাসারি দেখা হবার সুযোগ হলো। এখনো আমার মনে পড়ে, হ‌ুমায়ূন আহমেদের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’র কথা। নাটকটি প্রচার হবার দিন অনেক আগে থেকেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসত- বিস্ময়কর! দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত- কারফিউ যেন! আমার প্রায় সব ম্যাজিক শো’র সময়ও নির্ধারণ করতাম এই নাটক প্রচারের সময় মাথায় রেখে। হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটক না দেখে কেউ আমার ম্যাজিক দেখবে এমন ভাবতেও পারতাম না। ওই সময়টুকু জাদু দেখাতে স্টেজে ওঠা সম্ভব ছিল না আমার জন্য।

নাটকে একজন তরুণ ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র ছিল। সে ছিল খুব গরিব। এক বড়লোকের বাড়ির চিলেকোঠায় থেকে লেখাপড়া করা ওই তরুণের প্রেমে পড়ে গেল বাড়ির আদুরে মেয়েটি। এ রকম যখন নাটকটি এগোচ্ছে, তখন একদিন মুস্তাফিজ ভাইয়ের (বিটিভির মুস্তাফিজুর রহমান) কাছ থেকে আমার কাছে ফোন এলো।  তিনি ল্যান্ড ফোনে আমাকে বললেন- জুয়েল, টিভি স্টেশনে একটু আসতে পারবেন?

আমি বললাম, অবশ্যই। কখন আসতে হবে? বললেন, এখনই পারলে ভালো হয়। আমি দ্রুত রওয়ানা দিলাম বিটিভি’র উদ্দেশ্যে। মুস্তাফিজ ভাইয়ের রুমে গিয়ে ‘এইসব দিনরাত্রি’র প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ কলাকুশলীদের দেখতে পেলাম। তাদের অধিকাংশই আমার পূর্ব পরিচিত। মুস্তাফিজ ভাই আমার সাথে নতুন একজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি হ‌ুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেললাম, আমি আপনার বিরাট ফ্যান। এই বলে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। আমার সঙ্গে করমর্দন করতে করতে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, কে কার ফ্যান?
তিনি বললেন, ‘আমি আপনার জাদুর ফ্যান।’

তার একটু পরেই আমার জন্য একটি পরীক্ষা অপেক্ষা করছিল। উপস্থিত সবাই আবদার করলেন, জাদু দেখাতে হবে। হ‌ুমায়ূন আহমেদও সায় দিলেন। আমি তো জাদু দেখানোর প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি। একটি পয়সা চেয়ে নিলাম। যতোদূর মনে পড়ে, পঞ্চাশ পয়সা। তারপর জাদুর মাধ্যমে পয়সার ধারালো একটা পাশ অতি ধীরে ধীরে বাম বাহুর মধ্যে ঢুকে গেল। প্রায় সবাই হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনুভব করল, শক্ত কয়েনটি তখনো আমার হাতের চামড়ার নিচে। মাংসের মধ্যে অনুভব করা যাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম, হ‌ুমায়ূন আহমেদ একটু শক্ত হয়ে বসেছেন। তিনি প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টি ছিল আমার হাতের দিকে। মেধাবী দর্শকের এই দৃষ্টি আমার চেনা। ভেতরে আনন্দ অনুভব করলাম। কারণ, কোনো আত্মবিশ্বাসী বড় ম্যাজিশিয়ান যখন অন্য কারও ম্যাজিক দেখে মোহিত হন, তখন এমন করেই তাকান।

মুস্তাফিজ ভাই আমাকে জানালেন তিনি কেন ডেকেছেন। বললেন ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকে জুয়েল আইচ নামে একজন ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র আছে।  যিনি গরিব তরুণ ম্যাজিশিয়ানকে টেলিভিশনে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করবেন। কাজেই এই নাটকে আপনাকে একটু অভিনয় করতে হবে এই জায়গায়। আমিও চিন্তা-ভাবনা করে বলে দিলাম, ‘আবশ্যই করে দেব। আনন্দের সঙ্গে করে দেব।’

সেদিন হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যে বন্ধুত্ব তৈরি হলো সেটাও ম্যাজিকের মতো। তার চোখে বিস্ময়ের পাশাপাশি আমার জাদুটি আবিষ্কারের বাসনা লক্ষ্য করেছিলাম। এরপর আমাদের সম্পর্ক এমন বিস্ময়েই এগিয়েছে। একজন আরেকজনকে আবিষ্কারের চেষ্টা কখনো থেমে থাকেনি। 

হ‌ুমায়ূন আহমেদের নিজ হাতে আঁকা পেইন্টিং শোভা পাচ্ছে আমার ঘরের দেয়ালে। মনের দেয়ালে তার যে ভাস্কর্য প্রোথিত রয়েছে, তা দেখানো সম্ভব নয়! প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো কারণে তার কথা আমার মনে পড়ে। ধরা দেয় তার অসংখ্য স্মৃতি। ইচ্ছে হলেও তার কথা মনে করে আমি চিৎকার করে কাঁদতে পারি না- এ এক অসহ্য বেদনা!

অনুলিখন: স্বরলিপি

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়