ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বিদায় ‘আমার ছেলেবেলা’ 

কামরুল আহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২২  
বিদায় ‘আমার ছেলেবেলা’ 

আশি-নব্বই দশকে যারা বেড়ে উঠেছেন তাদের কারো সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক অথবা নিতান্তই জগতজীবনের তথ্যতত্ত্ব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলে এক পর্যায়ে আপনাতেই বুঝতে পারি- তিনি সেবা প্রকাশনীর বই পড়েছেন কিনা। আধুনিক এ-সময়ে বই না পড়লে মানুষ এমনকি স্মার্টও হতে পারে না।

স্মার্ট মানে সমাজের আর দশজনের সঙ্গে চলার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠা। শুধু চাকরিবাকরি, কাজকর্ম, ব্যক্তিগত পেশা-নেশার আলাপে এখন সবার পেট ভরে না। আড্ডার সীমা ও পরিধি বাড়াতে চাইলে নিজের চৌহদ্দির বাইরে পা বাড়াতেই হয়। সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে নিজের কৌতূহলের সীমা নানান দিকে ছড়িয়ে দিতে হয়। সেক্ষেত্রে বই-ই আধুনিক সময়ে সহজ ও সুন্দর মাধ্যম। যদিও আজকাল ফেসবুক, ইউটিউব এসে বইয়ের অনেকখানি জায়গা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বইয়ের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। বই শান্ত-স্নিগ্ধ স্বাস্থ্যকর। কাগজে তৈরি দুমলাটের এ-বস্তুটি মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে সহজেই সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। এমনকি স্ক্রিনে পড়া বইও বেশি কাজে লাগে না। গবেষণায় দেখা গেছে স্ক্রিনে পড়া বই মানুষ তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। যাই হোক, সে অনেক আলাপ, অন্য আলাপ। আজকে আমি যা বলতে চাচ্ছি সে এক বিরাট প্রতিষ্ঠানের কথা। সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম সেবা প্রকাশনী। সেবার কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন এই প্রতিষ্ঠানের সমার্থক নাম। 

যে-কোনো দেশের মানুষ যখন বই পড়তে শুরু করে সাধারণত সে-দেশের জনপ্রিয় ধারার বইপত্র দিয়েই শুরু করে। অনেকে বেছে নেয় রূপকথা, ভূতের গল্প, রহস্যগল্প ইত্যাদি। বাংলাদেশে এ-ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি ছিল বলাবাহুল্য। সবেধন নীলমণির মতো আমাদের হাতে ছিল কেবল ঠাকুর মার ঝুলি। কিশোর-উপযোগ্য গল্পের ছিল নিদারণ অভাব। যা ছিল তাও কলকাতানির্ভর; বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের নিজস্ব কিছু ছিলো না। আমাদের গোয়েন্দারাও ছিল সব বিদেশী, পরদেশী। সেবা প্রকাশনী প্রথম আমাদের নিজেদের গোয়েন্দা চরিত্র গড়ে তোলে। কিশোর পাশা, মাসুদ রানা আমাদের পরিচিত গোয়েন্দা। বয়সের সাথে সাথে নিজেকেই আমরা কিশোর পাশা বা মাসুদ রানা হিসেবে ভাবতে শিখেছি। শুধু কিশোর থ্রিলার নয়, কিশোর ক্লাসিকও আমরা পড়তে শুরু করেছি সেবা প্রকাশনীর হাত ধরেই। রবিনসন ক্রুসো, মবিডিক-এর মতো কালজয়ী বিখ্যাত বইও আমরা পড়তে পেরেছি সেবা প্রকাশনীর কল্যাণে। 

আমরা যারা সেবা প্রকাশনীর বই পড়ে বড় হয়েছি, একমাত্র আমরাই জানি, অন্য একজন সেবা প্রকাশনীর পাঠক কাছে পেলে আমাদের কী আনন্দ হয়। আমরা তখন অনায়াসেই অনেক ভাব আদান-প্রদান করতে পারি। সেবার পাঠকদের একটা বিষয় দেখা যাবে, তারা কোনো বিষয়েই খুব বেশি রক্ষণশীল না। যে-কোনো বিষয় সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে, এবং চাইলে নিজের মতামতটাও প্রকাশ করতে পারে।

বই অনেকেই পড়েন, অনেকে হয়তো একটু দেরিতে গিয়ে বইয়ের সংস্পর্শ পান। অনেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গিয়েও বই পড়তে শুরু করেন। দেরিতে যারা বই পড়তে শুরু করেন তাদের মধ্যে পাঠকের কোমলতা দেখা যায় না। বরং ‘আমি যে জানি’ এই ভাবটাই প্রবল হয়ে যায়। সেবার পাঠকদের মধ্যে এই অহঙ্কারী ভাবটা কখনো দেখা যাবে না। বই পড়া তার অভ্যাস, কোনো দেখানোপনার ব্যাপার না। নিজের শখে-আনন্দে কখন বই পড়তে শুরু করেছে তা সে নিজেও জানে না। সেবার পাঠকদের মধ্যে গোগ্রাসে পড়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাবে। 

কারণ তার পাঠাভ্যাস শুরু হয়েছে স্কুলজীবন থেকে। স্কুলের পড়া ও খেলারধুলার ফাঁকে, অনেক সময় বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে একেকটা বই শেষ করতে হয়েছে। পড়ার গতি তাতে আপনাতেই বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত পড়তে পড়তে পড়ার গতি বাড়ে বটে। আরেকটা বিষয় হলো, বড় হয়ে যারা পড়তে শুরু করেন তারা সাধারণত এক বইয়ের পাঠক হন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়ের বাইরে যেতে পারেন না। সেবার পাঠকরা খুব সহজেই বিষয় পরিবর্তন করতে পারে। এ- ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রহস্যপত্রিকার। রহস্যপত্রিকায় ছিল বিচিত্র বিষয়ের আয়োজন। জানা-বোঝার ক্ষেত্রটা তাতে অনেক বেড়ে যেত। 

নানা কারণে বাংলাদেশের সামাজিক বৈষম্য প্রকট। এখানে একে অপরের সঙ্গে অমিল প্রচুর। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, শিক্ষাগত বৈষম্যই এখানে প্রবল। এক মাদ্রাসার শিক্ষারই আছে বহুরকম ব্যবস্থা। সাধারণ শিক্ষাপদ্ধতিও বহুদাবিভক্ত। বইপত্র পড়ার অভ্যাস শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এখানকার শিক্ষাপদ্ধতিই আমাদের মধ্যে নানান ভেদরেখা তৈরি করে দিয়েছে। সাহিত্য সেই বিভাজন কিছুটা ঘুঁচিয়ে দেয়। আশ্চর্য হলেও সত্য, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমাদের পারস্পরিক সম্মিলনের সুর সবচেয়ে বেশি যে-দুজন জাদুকর বাজিয়েছেন তাদের একজন হ‌ুমায়ূন আহমেদ, আরেকজন কাজী আনোয়ার হোসেন। 

হ‌ুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠান ছিলেন না, শুধু লেখকই ছিলেন। কাজী আনোয়ার হোসেন শুধু প্রকাশক অর্থে নয়, নানা দিক দিয়েই প্রতিষ্ঠান ছিলেন। তার হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে অজস্র লেখক। রওশন জামিল, নিয়াজ মোর্শেদ, রকিব হাসান, শেখ আব্দুল হাকিম, খসরু চৌধুরী, কাজি শাহনূর হোসেনসহ আরো অনেকে। পাঠক তৈরিতে তার ভূমিকা এক এবং অদ্বিতীয়। অনেকে হ‌ুমায়ূন আহমেদকেও পাঠক তৈরির ভূমিকা দিতে চান। কিন্তু হ‌ুমায়ূন আহমেদের পাঠকদেরও তৈরি করেছে সেবা প্রকাশনী। হ‌ুমায়ূন নিজেও সেবা প্রকাশনীর জন্য লিখেছেন।

বর্তমান তরুণ প্রজন্মের হতাশা বাড়ছে। তারা সমাজ থেকে তো বটেই, পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন। তারা কী খায়, কী পরে, কী করে বাবা-মা জানেন না। আমাদের বাবা-মা জানতেন আমাদের দৌড় বড়জোর পাঠ্যপুস্তকের ভেতরে লুকিয়ে একটি গল্পের বই পড়া পর্যন্ত। একটি গল্পের বই আমাদের বন্ধুদের মধ্যেও সেতুবন্ধন তৈরি করত। এ-ক্ষেত্রে সেবার অবদান অনস্বীকার্য।

কাজী আনোয়ার হোসেন তাই এখন লেখক শুধু নন, একটি প্রতিষ্ঠানও শুধু নন, তিনি সমাজের ভারসাম্যরক্ষাকারী একটি বিরাট বটবৃক্ষ। তিনি যেন এ-শহরের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। তিনি চলে গেলেন, তার সঙ্গে চলে গেল আমাদের ছেলেবেলা।  

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়