ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গুরু গদারকে চিঠি

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৩, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২  
গুরু গদারকে চিঠি

গুরু গদার
সালাম জানবেন। এই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছাবে কি না জানি না। আমি খোলা চিঠিই দিচ্ছি। আর আমি তো বিশ্বাস করি আপনি চাইলে এ চিঠি পড়তেও পারবেন। কারণ আপনার কাছে তো ‘ভাষা’, ‘দেশ’ এসব কিছুই কোনো ব্যাপার না।

আপনার ‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামের সিনেমা ২০১৪ সালে মুক্তি পায়। তখনই বুঝেছিলাম আপনি ভাষা আর ভূগোলের ঊর্ধ্বে। সেটা ছিল আপনার ১২১তম ভিডিও প্রয়াস। হুঁ, আপনি ছিলেন লেখক, দার্শনিক। আপনার মাধ্যম ছিল ভিডিও, চলচ্ছবি বা চলচ্চিত্র। আপনাকে শুধু চলচ্চিত্রকার মানতে আমি রাজী নই। আমরা তো জানি, শুরুতে এই পৃথিবীর মানুষ চেয়েছিল স্থির ছবিকে চলচ্চিত্র বানাতে। সেই আদিকাল থেকে মানুষ ছবি আঁকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই সব ছবি নড়ছিল না। তারপর ম্যাজিক লণ্ঠন, জিওট্রোপ,  জুপ্রাক্সিসকোপ, সিনেমাটোগ্রাফে, ৩৫ মিমি, থ্রিডি কতো রকম ক্যামেরা আর প্রযুক্তি আবিষ্কার হলো। নিসেফোর নিসেপ, এডওয়ার্ড মুইব্রিজ, লুই লে প্রিন্স, টমাস আলভা এডিসন, অগাস্ট লুমিয়ের, লুঁই লুমিয়েরের মতো কতো প্রতিভা এলেন, তারা সবাই মিলে ঠিক স্থিরচিত্রগুলো সচল করে দিলেন। 

মানুষ দেখলো সিনেমার পর্দায় আস্ত ট্রেন, হাতি ছুটে যাচ্ছে। চলাচল করছে মানুষ। তারপর সেই সব চলন্ত মানুষ কথা বলতে শিখলো। কিন্তু সিনেমা তখনও সাবালক হলো না। কেবল নড়লে চড়লেই কি প্রাণ হয়? সেই ১৯১৫ সালে গ্রিফিথ বানালেন ‘বার্থ অব আ ন্যাশন’। সেই বিতর্কিত সিনেমা নিয়ে অনেক কথা হলো। নিজের বর্ণবাদী দোষ ঢাকলেন পরের বছরই ‘ইন্টরালেন্স’ (১৯১৬) বানিয়ে। গ্রিফিথ তারপর সিনেমায় প্রাণ দিলেন। কেবল নড়াচড়া নয়, সিনেমা পেলো আত্মা। যেমন ভিঞ্চি মোনালিসার ছবিতে আত্মা যোগ করতে পেরেছিলেন, তেমনি গ্রিফিথ ইন্টলারেন্সে আত্মা ফুঁকে দিলেন। সিনেমার আত্মা। আর আপনি বললেন ‘ফিল্ম শুরু হয়েছে ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ থেকে আর শেষ হয়েছে আব্বাস কিয়ারোস্তামি থেকে।’ 

গ্রিফিথ মারা গেলেন ১৯৪৮ সালে আর আব্বাস কিয়ারোস্তামি চলে গেলেন এই তো ২০১৬ সালে, আপনার প্যারিসেই মৃত্যু হলো তার। মৃত্যু নয়, আসলে মর্তধাম ছেড়ে চলে যাওয়া। কেননা, আপনার কথা মেনে নিলে, গ্রিফিথ, আব্বাস কিয়ারোস্তামিরা মরে গেলে তো সিনেমাও মরে যাবে, সিনেমারও শেষ হবে। কিন্তু তা তো হবার নয়। সিনেমা, সে তো আপনি জানেন, অমর। আপনার মতোই সিনেমা অমর। কিংবা সিনেমার মতো আপনি অমর। শুধু অমর নয়, সে সচল, চলচ্চিত্র চলছে। আর আপনিও চলছেন। গ্রিফিথ, কিয়োরাস্তামি আর আপনি এবং আপনাদের অসংখ্য উত্তরসূরী সিনেমা বানিয়ে চলছে, আপনাদের বানানো নিয়ম আর আপনাদের ভেঙে দেওয়া ব্যাকরণ ভেঙে লোকেরা সিনেমা বানাচ্ছে, বানাতে থাকবে। সিনেমার মৃত্যু নেই। আপনাদেরও মৃত্যু নেই। কেবল মর্তের ক্লান্তিকর ভ্রমণ থেকে আপনি সরে গেলেন ৯১ বছর বয়সে।

গুরু, অতো ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি, তাই কোনদিন কথা হলো না আপনার সঙ্গে। কথা বলে গেলাম আপনার সিনেমার সঙ্গেই, তা-ও এক তরফা। তবু সান্ত্বনা, আপনার সিনেমা তো আপনিই, মানে আপনার মতো করে সিনেমার ভেতরে আর কেইবা প্রবেশ করেছে! আপনি আর সিনেমা আত্মা আর দেহ। কিন্তু আপনার আত্মা দেহে বন্দী নয়, আপনার দেহও আত্মায় বন্দী নয়। আপনি বললেন, ‘আমি সিনেমা ছাড়া জীবন সম্পর্কে আর কিচ্ছু জানি না।’

আপনি যা জানেন, জীবন সম্পর্কে, সিনেমা সম্পর্কে সেই সব আমাদের দিয়ে গেলেন অকাতরে। অকাতরে গ্রহণ করা তো আপনি শিখিয়েছেন আমাদের। আপনি যখন প্রথম সিনেমা ‘ব্রিথলেস’ বানিয়েছিলেন তখন শেষ দৃশ্যে নায়ক পেছন থেকে গুলি খেলো, সে আর মর্তের বাতাস নিতে পারলো না। আমরা বোকার মতো বললাম মিশেল মারা গেছে। কিন্তু যে মিশেল জীবনকে থোড়াই পাত্তা দেয়, যে মিশেল হাঁটতে হাঁটতে খবরের কাগজ পড়ে আর সেই খবরের কাগজটি দিয়ে জুতো মুছে ছুঁড়ে ফেলে, যে মিশেল প্রেমিকা প্যাট্রেসিয়ার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে আর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে ‘ব্রা পরোনি কেন?’- সেই মিশেলের মৃত্যু কি সম্ভব?

মিশেল যে কিনা হলিউডের কিংবদন্তী অভিনেতা হামফ্রে বোগার্ডকে অনুকরণ করতেন, তার মতো করে হাঁটার চেষ্টা করতেন, সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতেন, সেই মিশেল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জঁ পল বেলমন্ড। আপনি জীবিতকালেই দেখে গেছেন আপনার মিশেল ওরফে আপনার তৈরি করা অভিনেতা জঁ পল বেলমন্ডকে পরবর্তীকালে অনুসরণ করেছে, অনুকরণ করেছে মার্লোন ব্রান্ডো, আলপাচিনো, রবার্ট ডি নিরো’র মতো হলিউডের কিংবদন্তী অভিনেতারা। আর স্বয়ং আপনাকে, আপনার সিনেমাকে অনুসরণ করেছে, অনুসরণ করেছে কুইন্টিন টারান্টিলো, মার্টিন স্কুসেস, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, জর্জ লুকাস, ডেডিভ লিঞ্চ, ওয়ংকার ওয়াই, আব্বাস কিয়ারোস্তামির মতো অসংখ্য পরিচালক। 

গুরুজি, আপনি নেহাত একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, আপনি বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, আপনি দ্রোণাচার্য। আপনি দ্রোনাচার্যের চেয়েও মহৎ। কারণ গুরুদক্ষিণাও চাননি আপনি। কতো একলব্য আপনাকে গুরু মেনে ক্যামেরা চালিয়েছে, সিনেমা বানিয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই আজও। কেননা, সিনেমাকে নিয়ে সম্ভব আর অসম্ভব সব কাজই আপনি করে দেখিয়েছেন। শুধু একটা কাজ আপনি করলেন না, আফসোস, আপনি এই বাংলার দিকে তাকালেন না, আপনি যদি একবার আপনার নশ্বর নজরটি এদিকে ঘুরাতেন আমরা অবিনশ্বর সিনেমা পেতাম। আমার প্রিয় সিনেমা সমালোচক রজার এবার্ট আপনার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘গদার হলো একদম প্রথম সারির পরিচালক; ১৯৬০-এর দশকের আর কোনো পরিচালক পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্রের উন্নয়নে এতো প্রভাব রাখেনি। যেমন জেমস জয়েস কাহিনীতে, বেকেট থিয়েটারে, তেমনি তিনিও এক অগ্রগণ্য যার বর্তমান কাজ বর্তমানের দর্শক গ্রহণ করতে পারছে না। কিন্তু অন্য পরিচালকদের উপর তার প্রভাব ক্রমশই তৈরি হচ্ছে আর এক শ্রেণীর দর্শক শিক্ষিত হচ্ছে, ধারণা করা যায় এই পরের প্রজন্মের দর্শকরা সক্ষম হবে তার ফিল্মের দিকে ফিরে তাকানোর আর বুঝতে পারবে এইখানেই সিনেমার শুরু হয়েছিল।’

এ কথা তো সত্য, ক্রমশ সিনেমাকে আপনি দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছেন। কারণ, আমাদের কবিগুরু যেমন বলেছিলেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি’ আপনি তেমনি সিনেমাগুরু হিসেবে মানতেন, যা বানাবে চলচ্চিত্রকার তাই সত্য। আপনি বলেছিলেন, ‘ফটোগ্রাফি হলো সত্য। সিনেমা হলো সেকেন্ডে ২৪ গুণ সত্য।’ আমরা তত্ত্বগতভাবে জানতাম, ২৪টা স্থির চিত্র এক সেকেন্ড দেখালে স্থিরচিত্রগুলো চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের সকল তত্ত্বীয় জ্ঞান আপনি সত্য বলে প্রমাণ করলেন, আপনার কাজে, আপনার সিনেমায়। আপনি সিনেমাকে নিয়ে গেলেন প্রতিবাদের জগতে, প্রজ্ঞার জগতে। 

বিশ্ব যখন সিনেমাকে বিনোদন ভাবে, হলিউডের প্রবল প্রভাবে বিশ্ব সিনেমা ছায়াচ্ছন্ন, তখন আপনি বললেন, ‘একটা মুভির জন্য যা কিছু দরকার তোমার তা হলো একটা মেয়ে মানুষ আর একটা বন্দুক।’ এক কথায় আপনি আদতে বুঝিয়ে দিলেন, সিনেমার ক্যামেরা সেই ‘গ্রেট ট্রেন রবারি (১৯০৩)-এর আমল থেকে, সেই ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’ (১৯২৮)-এর আমল থেকে একটা বন্দুকের দিকে কিংবা নারীর দিকে তাক করে রয়েছে। আপনি নিজেও প্রথম সিনেমা ‘ব্রিথলেস’ (১৯৬০)- এ দেখিয়ে দিলেন নায়ক মিশেলের হাতে আছে একটা পিস্তল আর সঙ্গে আছে নায়িকা প্যাট্রেসিয়া। এই পিস্তল আর প্যাট্রেসিয়া শেষতক গল্প টেনে নিয়ে গেলো। কিন্তু আপনি জানতেন গল্পকে কান ধরে ঘুরিয়ে আনতে। তাই গল্পের ‘আদি-মধ্য-অন্তের’ এরিস্টটলীয় বিভাজন রীতি মানলেন না। আপনি নতুন করে বললেন, ‘একটা গল্পের সূচনা, মধ্য এবং অন্ত থাকা উচিত, তবে সেটা এই ধারাবাহিকতায় থাকতে হবে তেমন জরুরি নয়।’ 

তারপর আমরা দেখলাম, একের পর এক সিনেমায় গল্প বলার ধারাবাহিকতা আপনি বাদ দিলেন। এমনকি ‘গুডবাই ল্যাঙ্গুয়েজ’ (২০১৪) সিনেমাতে এসেছে আপনি সিনেমাকে একটা প্রবন্ধের মতো করে ফেললেন। এখানে যেন গল্প নেই, আছে ভাবনা, একটা আলোচনা। একটা সিনেমার মধ্যে আপনি এতো উদ্ধৃতি, এতো তথ্যসূত্র, পূর্বসুরী শিল্পী, বিজ্ঞানী, কবি, দার্শনিকদের নাম এতোবার উচ্চারণ করলেন আমাদের মনে হলো আমরা সিনেমা দেখছি না, কোনো আকড় গ্রন্থ পাঠ করছি। আর এই থ্রিডি ক্যামেরার সিনেমায় আপনি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ নীরিক্ষা করলেন। যে থ্রি ডি চশমা পরে আমরা ত্রিমাত্রিক সিনেমা দেখি, সেই চশমার দুই চোখের জন্য আপনি দুই রকম দৃশ্য ধারণ করলেন। দুই জোড়া নায়ক-নায়িকা ব্যবহার করলেন একই সিনেমায় একই চরিত্রসূমহের জন্য। একই স্বামী, একই স্ত্রী কিন্তু দুজন করে শিল্পী, যেন আয়নার মধ্যে একজন দেখছে আরেকজনের জীবন। আমরা স্তব্ধ, বিস্মিত হয়ে গেলাম আপনার সিনেমার নীরিক্ষা, আপনার চিন্তার গভীরতা আর আপনার পঠন-পাঠনের ঋদ্ধতা দেখে।

সিনেমা যে পাঠ করতে হয়, সেও তো আমরা আপনার সিনেমা দেখেই জানলাম। সিনেমা শুধু দেখলেই হয় না, যেমন তাকিয়ে থাকলেই আকাশের মেঘ বা মাটির ফুলকে বোঝা হয় না, তেমনি আপনার সিনেমা দেখলেই সব বোঝা যায় না। পাঠ করতে হয়। বারবার আপনার সিনেমার দৃশ্যগুলো পড়তে হয়, পড়তে হয় আপনাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। সিনেমা যে রীতিমতো পড়ালেখার ব্যাপার সে আপনার সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। আজকের পৃথিবীতে একটি ফিল্ম স্কুল নেই, একটি চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে আপনাকে পড়ানো হয় না। আপনি সিনেমার পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভূক্ত নাকি সিনেমাকে আপনি পাঠ্যের উপযুক্ত করেছেন তা-ও আমাকে ভাবায়। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি সেই ১৯৬১ সালে আপনি যে সিনেমা বানালেন ‘আ উইম্যান ইজ আর ওম্যান’ সেখানে নায়ক-নায়িকারা ঝগড়া করে বিছানায় শুয়ে আছে, তারা কথা বলবে না, কিন্তু তাদের রাগ প্রকাশিত হয় বইয়ের ভাষায়। তারা বিছানা থেকে ওঠে বেড সাইড ল্যাম্প নিয়ে হেঁটে যায় বুক সেলফে। দুজনেই একেকবার ল্যাম্প নিয়ে একের পর এক বই তুলে নিয়ে আসে। তারপর বইয়ের নামগুলো আংশিক ঢেকে দেখায়। সেই সব বইয়ের নামের মধ্য দিয়ে তারা কথা বলে। বিশ্ব সিনেমায় বইয়ের প্রচ্ছদ ব্যবহার করে সংলাপ দেওয়ার এমন নজির সৃষ্টি করা আপনার পক্ষেই সম্ভব।

আর ‘গুডবাই ল্যাঙ্গুয়েজ’ (২০১৪) বানানোরও বহু আগে ‘ভিভ সা ভি’ (১৯৬২) সিনেমাতে আপনি একজন পতিতার সঙ্গে একজন পতিতের সাক্ষাত করালেন। আর তারা ভাষার প্রয়োজনিয়তা, নীরবতার প্রয়োজনিয়তা নিয়ে কথা বললো। ভাষা কি ঠিকঠাক যোগাযোগ করায় এমন প্রশ্ন আমরা শুনলাম। ভাষা নিয়ে আপনার ভাবনার সূচনা সেখান থেকে হলো। আর আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, আপনারা যারা ফরাসি ভাষায় কথা বলেন, তারা বুঝলাম, মুখের ভাষা এক জিনিস আর সিনেমার ভাষা আরেক জিনিস। সিনেমা কথা বলে ক্যামেরার ভাষায়, সিনেমায় থাকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সিনেমায় থাকে সম্পাদনার ভাষা। সেই যে প্রথম সিনেমা ‘বিথ্রলেস’ (১৯৬০) দিয়েই ‘জাম্পকাট’ নামের এক সম্পাদনা কৌশল আপনি আবিষ্কার করলেন তখন আমাদের মনে হলো আধুনিক জীবনের দর্শন আপনি ধরতে পেরেছেন। এই যে অস্থিরতা, এই যে ছুটে চলা, সেই অস্থিরতা, সেই ছুটে চলায় আপনার সম্পাদনাও ছুটে চলল।

গাড়ির দরজা খুলছেন নায়িকা, তারপর তাকে আর গাড়িতে উঠতে দেখি না আমরা, কারণ অতো দীর্ঘ সময় আপনি দিতে চাইলেন না। আপনি দরজা খোলার পর নায়িকাকে চলন্ত গাড়ির সিটে বসা দেখালেন। যেমন আমরা পারলে লাফ দিয়ে, অদৃশ্য দ্রুততায় চলে যেতে চাই এক ধাপ পেরিয়ে, যেমন সিঁড়ির দুটো ধাপ, তিনটে ধাপ এক লাফে পার হই, তেমনি আপনি আমাদের সিনেমা দর্শনকেও করলেন অস্থির, দ্রুত গতির, কখনো দুরূহ, দুর্বোধ্য এবং প্রায়শই আপনি অসম্ভবকে সম্ভবের দুয়ারে এনে মাথা কুটালেন।

ম্যাসকুলিন ফ্যামিনিন (১৯৬৬) সিনেমায় আমরা কমিউনিস্ট পলকে দেখালেন বস্তুবাদী দুনিয়ার আবহে। সে ভালোবাসলো একজন পপ সিঙ্গারকে। এই সিনেমায় আপনি দেখালেন সংলাপের চেয়েও শব্দ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পল যখন ক্যাফেতে বসে সমাজতন্ত্র আর দর্শনের কথা বলছে তখন তার সংলাপ শোনা যাচ্ছে না, আমরা ক্যাফের অন্যান্য শব্দ শুনছি। আর পল তার কথা শোনানোর প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। পল যা বলছে আর আশেপাশের যা শব্দ হচ্ছে তার বৈপরীত্য আমাদের বুঝিয়ে দেয়, সিনেমায় শব্দ আর সংলাপের সম্পর্ক কতো দ্বান্দ্বিক হতে পারে। আমরা যেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কাছেই ফিরে যাই। 

আমার বিবেচনায়, আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চিন্তার সিনেমা ‘পিঁয়রে লে ফু’ (১৯৬৫)-তে আপনি গল্প বলেছেন রঙের সাহায্য নিয়ে। রঙিন সিনেমায় রঙ যে চাকচিক্য বাড়ানোর নয়, রঙ যে কথা বলে চিত্রকলায় আমরা তা দেখেছি, এবার সিনেমায় দেখলাম। আপনার প্রিয় অভিনেতা বেলমন্ডকে আমরা এ ছবিতে সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ ফার্দিনান্দের চরিত্রে পেলাম। সে জীবনে আরো আয়েশ চায়, আর ভরপুর জীবনের আয়োজন চায়। আর আপনি বেলমন্ডকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে পুরো সিনেমায় লাল আর নীলের ব্যবহার করলেন বিস্তৃতভাবে। আমরা দেখলাম  নীল রঙ ফার্দিনান্দের সেই বুর্জোয়া অভিজাত জীবনের প্রতিফলন করে যা সে যাপন করছে আর লাল রঙ হচ্ছে তার কামনা, আকাঙ্খার সেই জীবনের প্রতিফলন যা সে আগামীতে চায়। একই সিনেমায় আপনি প্রেম, বুর্জুয়াতন্ত্র, ধনতন্ত্র, অস্তিত্ববাদ তুলে ধরলেন আপনি। মারিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পর আমরা দেখি ফার্দিনান্দ ডায়েরিতে লিখছেন ‘আমি কখনোই মারিয়ার আনুগত্য বুঝতে পারিনি।’ বিস্ময়রে সঙ্গে আমরা দেখেছি ফার্দিনান্দ লিখছেন নীল কালিতে, আর সে যখন শেষ দৃশ্যে চলে গেলো তখন তার পরনে নীল স্যুট। এর আগে মারিনার লাল পোশাকে সে বন্দী হয়। যেন কমিউনিস্ট ধারণার স্বপ্নই বন্দী হয়ে যায়।

কখনো রঙে, কখনো শব্দে, কখনো সম্পাদনায়, কখনো গল্পের ভাঙা-গড়ায়, কখনো সংলাপের গভীরতায় বা হালকা চলনে আপনি আমাদের বারবার ভাবিয়েছেন। আপনার ভাবনার সঙ্গে আমি আছি, আমরা আছি।

প্রিয় গদার, আমাদের সিনেমা গুরু, আপনি মর্তধাম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনার সিদ্ধান্তকে সালাম জানাই। কিন্তু বিশ্বাস করি, আপনি যে উঁচু দরের যাদুকর, নিশ্চয়ই কোথাও না কোথায় ঘাপটি মেরে বসে, আমার চিঠিটি পড়ছেন আর সিনেমার জগতে নতুন কোনো খেলার প্লট তৈরি করছেন।
আপনাকে সালাম।

ইতি মুম রহমান
বাংলাদেশের জনৈক চলচ্চিত্র লেখক
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়