ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

কারাগারে যেভাবে কাটছে দু’চোখ উপড়ানো শাহজালালের দিন

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কারাগারে যেভাবে কাটছে দু’চোখ উপড়ানো শাহজালালের দিন

টগবগে যুবক মো. শাহজালাল হাওলাদার। স্মার্ট, সুদর্শনও। ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জনক তিনি। স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল এ যুবকের দিনকাল। কিন্তু ভাগ্যের আকাশে নেমে আসে এক কালো মেঘ। যা সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। ভাগ‌্যের নির্মম পরিহাসে দু’ চোখই আজ তার অন্ধ। সর্বশেষ এই অন্ধের স্থান এখন কারাগারের অন্ধকার কুঠরি।

পরিবারের অভিযোগ, দাবিকৃত অর্থ না পেয়ে খালিশপুর থানা পুলিশ শাহজালালকে ধরে নিয়ে তার দু’ চোখই উপড়ে ফেলেছে। উল্টো পুলিশের ইন্ধনে তার বিরুদ্ধে ছিনতাই মামলাও দায়ের করা হয়। সম্প্রতি ওই ছিনতাই মামলার রায়ে অন্ধ শাহজালালকে আদালত দু’ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরেই শাহজালাল খুলনা জেলা কারাগারে বন্দি জীবন-যাপন করছেন তিনি।

অন্যদিকে, পুলিশের বিরুদ্ধে তার মায়ের দায়েরকৃত চোখ উপড়ানোর মামলা আদালত থেকে আদালত ঘুরছে। কিন্তু মিলছে না ন্যায় বিচার।

শাহজালাল হাওলাদার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের মো. জাকির হোসেন হাওলাদারের ‌জ‌্যেষ্ঠ‌ পুত্র। বসবাস করতেন খুলনা মহানগরীর খালিশপুরের নয়াবাটি রেললাইন বস্তি কলোনিতে শ্বশুরবাড়িতে।

ছিনতাই মামলা ও রায় ঘোষণা :

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই রাতে খুলনা মহানগরীর গোয়ালখালী এলাকায় ছিনতাইয়ের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ শাহজালালকে গ্রেপ্তার করে। ওই রাতেই শাহজালালকে চোখ উৎপাটন করা অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতে সোমা আক্তার নামে এক নারী বাদী হয়ে শাহজালালসহ দুই জনের নামে ছিনতাই মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় শাহজালাল জামিনে ছিলেন।

৪ নভেম্বর খুলনা মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আমিরুল ইসলাম এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে দু’চোখ অন্ধ শাহজালালকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত শাহজালালকে কারাগারে পাঠানো হয়।

রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শাহজালালের পক্ষের আইনজীবী মো. নুরুল হক বলেন, ‘চোখ উৎপাটনের ফলে শাহজালাল অন্ধ হয়েছেন। এ অবস্থায় শাহজালালকে দুই বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা দ্রুত উচ্চ আদালতে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

সর্বশেষ : গত ২১ নভেম্বর খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতে ছিনতাই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও জামিনের আবেদন করা হয়। আদালত আগামী বছরের ১৮ এপ্রিল আপীলের শুনানির দিন ধার্য করেছেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে রায়ের মূল নথি দায়রা জজ আদালতে না পৌঁছানোয় জামিনের শুনানি হয়নি।

একই কারণে ১ ডিসেম্বরও জামিনের আবেদন না-মঞ্জুর করেন আদালত। দ্রুত নথি প্রেরণ সাপেক্ষে আবারো আদালতে জামিনের আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন মামলার অপর আইনজীবী এ্যাড. মোমিনুল ইসলাম। দু’ চোখ অন্ধ হিসেবে মানবিক দিক বিবেচনায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করবেন বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।

পিছনের ঘটনা: ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই রাতে খুলনা মহানগরীর গোয়ালখালী এলাকায় এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই সময় শিশু সন্তানের জন্য দুধ কিনতে বের হওয়া শাহজালালকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করে খালিশপুর থানা পুলিশ। ওই রাতেই শাহজালালকে চোখ উৎপাটন করা অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একইসঙ্গে সোমা আক্তার নামে এক নারী বাদি হয়ে শাহজালালসহ দুই জনের নামে ছিনতাই মামলা দায়ের করেন।

ওই সময় শাহজালাল দাবি করেন, দেড় লাখ টাকা না পেয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে খালিশপুর থানা পুলিশ তার দু’ চোখ তুলে ফেলে। তবে পুলিশের দাবি, ছিনতাইকালে জনতার পিটুনিতে চোখ হারিয়েছেন শাহজালাল। এ ঘটনায় ওই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিমের আমলি আদালতে শাহজালালের মা রেনু বেগম বাদি হয়ে খালিশপুর থানার তৎকালীন ওসি নাসিম খান এবং ১১ পুলিশ সদস্যসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

এজাহারে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই তার ছেলে শাহজালাল মহানগরীর নয়াবাটি রেললাইন বস্তি কলোনির শ্বশুরবাড়ি থেকে রাত ৮টায় শিশুর দুধ কেনার জন্য বাসার পার্শ্ববর্তী দোকানে যান। এসময় খালিশপুর থানার তৎকালীন ওসি নাসিম খানের নির্দেশে তাকে থানায় ডেকে নেওয়া হয়।

পরিবারের সদস্যরা থানায় গেলে ওসি তাকে ছাড়ানোর জন্য দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। দাবি করা টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ কর্মকর্তারা শাহজালালকে পুলিশের গাড়িতে করে বাইরে নিয়ে যায়। পরদিন ১৯ জুলাই খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তাকে দুটি চোখ উপড়ানো অবস্থায় দেখতে পান পরিবারের সদস্যরা।

এ সময় শাহজালাল জানান, পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে গাড়িতে করে গোয়ালখালী হয়ে বিশ্বরোডের (খুলনা বাইপাস সড়ক) নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তার হাত-পা চেপে ধরে এবং মুখের মধ্যে গামছা ঢুকিয়ে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে দু’চোখ উপড়ে ফেলে।

মামলার আসামিরা হলেন- খালিশপুর থানার সাবেক ওসি মো. নাসিম খান, এএসআই রাসেল, এসআই তাপষ কুমার পাল, এসআই মো. মোরসেলিম মোল্লা, এসআই মো. মিজানুর রহমান, কনস্টেবল আল মামুন, আনসার সিপাই মো. আফসার আলী, ল্যান্স নায়েক আবুল হাসেম, আনসার নায়েক রেজাউল হক, এসআই মো. নূর ইসলাম, এসআই সৈয়দ সাহেব আলী এবং সহযোগী সুমা আক্তার ও মো. রাসেল।

আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই খুলনার পরিদর্শক মো. বাবলুর রহমান খান আদালতে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, মামলার কোনও আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের সপক্ষে কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বাদী পক্ষে আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করা হয়। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি খুলনা মহানগর হাকিম মো. শাহীদুল ইসলাম খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনারকে মামলাটির পুণরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।

এদিকে, প্রতিবেদন দাখিলের আগেই আসামিরা চাপ প্রয়োগ করে জোরপূর্বক মামলা তুলে নিতে বাধ্য করে বলে অভিযোগ করেন শাহজালালের বাবা জাকির হোসেন। পরবর্তীতে এ ঘটনায় তিনি হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন।

বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৮ জুলাই এ বিষয়ে চার সপ্তাহের রুল জারি করেন। রুলে সেশন জজ খুলনার ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের ক্রিমিনাল রিভিশন নং-২০৭ এবং একই বছরের ৩০ এপ্রিল খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের আদেশ (কেস নং-৩০৯, খালিশপুর) সম্পর্কে জানতে চেয়ে চাওয়া হয়।

পরিবারের প্রতিক্রিয়া : শাহজালালের মা রেনু বেগম বলেন, ‘ছেলের চোখ উৎপাটনের ঘটনায় তিনি নিজেই বাদী হয়ে ১১ জন পুলিশসহ ১৩ জনের নামে মামলা দায়ের করেছেন। কিন্তু আসামিরা অন্যায়ভাবে শাহজালালকে চাপে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক ছিনতাই মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে পাঠিয়েছে। এখন আমার ছেলেকে দু’চোখ হারিয়েও জেল খাটতে হচ্ছে। চোখে না দেখার কারণে কারাগারে তাকে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। দেখা করতে গেলে তার কষ্ঠের কথা শুনে চোখ ভিজে যায়।’

শাহজালালের বাবা মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তিনি তার ছেলের চোখ উৎপাটনের ঘটনায় খুলনার প্রশাসনের কাছে ন্যায় বিচার পাননি। যে কারণে উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হয়েছেন।’

কারা কর্তৃপক্ষ যা বললেন : খুলনা জেলা কারাগারের জেলার মো. জান্নাতুল ফরহাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, যেহেতু আদালত কর্তৃক রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাহজালাল কারাগারে এসেছে, সেখানে অন্ধ হলেও কারা কর্তৃপক্ষের করার তেমন কিছুই নেই। তবে, নিয়ম অনুযায়ী সশ্রম কারাদণ্ড হলেও দু’চোখ অন্ধ থাকায় তাকে দিয়ে কোন কিছু করা করানো হচ্ছে না, উপরন্তু তাকে সহযোগিতা করার জন্য অপর এক বন্দিকে নিয়োজিত করা হয়েছে। এছাড়া একজন স্বাভাবিক বন্দির মতই সে কারাগারের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে।


খুলনা/নূরুজ্জামান/বুলাকী

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়