ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ফরিদপুর সদরের সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ

ফরিদপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফরিদপুর সদরের সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ

করিমপুরের এই ব্রিজের কাছে গ্রেনেড ছুড়ে পাকসেনাদের জিপ উড়িয়ে দেয়া হয়

মহান মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর সদরের সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল কানাইপুর ইউনিয়নের করিমপুর গ্রামে।

৭১ সালের ৯ ডিসেম্বরের এ যুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামবাসীদের ঘরে আশ্রয় নিলে তাদের নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। আর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ায় পাকসেনারা চারজন গ্রামবাসীকেও হত্যা করে।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও ঐতিহাসিক এই করিমপুর যুদ্ধের কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই সেখানে।

করিমপুর যুদ্ধে শহীদ হওয়া সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন - কাজী সালাউদ্দিন, মেজবাহউদ্দিন নৌফেল, আব্দুল ওয়াহাব, সোহরাব হোসেন, আব্দুল আওয়াল, আব্দুল হামিদ ও মজিবুর রহমান।

মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ায় যাদের হত্যা করা হয় তারা হলেন ওই গ্রামের বাকেল উদ্দীন মন্ডল, হযরত উদ্দীন মন্ডল, হাশেম আলী মন্ডল ও আবু খাঁ।

ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আমিনুর রহমান ফরিদ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে পাক বাহিনীর একটি জিপ ও একটি ট্রাক ফরিদপুর ধোপাডাঙ্গা চাঁদপুরের দিকে আসছে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা কাজী সালাউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অপরদিকে বোয়ালমারীর নতুবদিয়া ক্যাম্প থেকে হেমায়েতউদ্দীন তালুকদারের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এবং গোরদিয়া ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াসের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ পাক হানাদার বাহিনীর ও রাজাকারদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।’

করিমপুর ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড ছুড়ে পাকসেনাদের একটি জিপ উড়িয়ে দেন। এরপর পাকবাহিনীর একটি বড় যুদ্ধ বহর সেখানে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা তিন-চার ভাগে বিভক্ত হয়ে গুলি করতে করতে পিছু হটে করিমপুর গ্রামে আশ্রয় নেন। পাকবাহিনী গ্রামটি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় নেওয়া বাড়িতে হানাদাররা আগুন ধরিয়ে দেয় এবং গুলিতে সাত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

যুদ্ধশেষে পরের দিন ১০ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী করিমপুর এলাকার বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ১৭ ডিসেম্বর ফরিদপুর স্বাধীন হলে করিমপুর থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে শহরের আলীপুর কবরস্থানে যথাযথ মর্যাদায় দাফন করা হয়।

ফরিদপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবুল ফয়েজ মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর প্রায় অর্ধশতক পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনও করিমপুরে একটি স্মৃতিসৌধ না হওয়া আমাদের জন্য লজ্জাকর।’

অপরদিকে ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় বোয়ালমারী উপজেলা। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধকালে পাক সেনারা বোয়ালমারী উপজেলার হাসপাতালে ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর পাকবাহিনী বোয়ালমারী থেকে পিছু হটে ফরিদপুরের দিকে মার্চ করে। এসময় এতদাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মজুরদিয়া এলাকায় অবরোধের চেষ্টা চালায়। সেখানে শত্রুপক্ষের পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরনে পা হারান মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বোয়ালমারী উপজেলা কমান্ডের সহকারী কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত হোসেনসহ মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, পাকসেনারা বোয়ালমারীর বিভিন্ন জায়গা থেকে নারী পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে গণকবর দেয়া হতো একটি ডোবায়। বোয়ালমারী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক গণকবর থাকলেও তা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজো।

উপজেলা চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন মনে করেন, সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের স্থানসহ গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সেখানে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা গেলে চেতনা ছড়িয়ে পড়বে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। এ লক্ষ্যে বোয়ালমারীর গণকবরগুলো চিহ্নিত করে অবিলম্বে স্মৃতিফলক নির্মাণ ও মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে।

 

ফরিদপুর/মনিরুল ইসলাম টিটো/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়