ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের শেষ স্মৃতিচিহ্নও নিশ্চিহ্নপ্রায়

আলী আকবর টুটুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের শেষ স্মৃতিচিহ্নও নিশ্চিহ্নপ্রায়

মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার প্রথম শহীদ ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সমাধিস্থল অবহেলায়-অযত্নে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণের অভাবে সমাধির আশপাশে লতাপাতা জন্মেছে। এভাবে অরক্ষিত থাকলে এক সময় হারিয়ে যাবে তার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা এই বীর শহীদের সমাধি সংরক্ষিত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সহযোদ্ধারা।

সামরিক বাহিনীর মর্যাদাপূর্ণ পদের চাকরি ফেলে দেশ-মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবনদান করা এই মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৪৪ সালে শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী সংলগ্ন দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার হোসেন। আলেপ খান ও জুমিনা খাতুনের চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আনোয়ার হোসেন ছিলেন সবার ছোট। ১৯৬৬ সালে সেনা বাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন তিনি। সর্বশেষ তিনি পাকিস্তানের খানে ওয়ালা ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন পদে নিযুক্ত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন আনোয়ার হোসেন। ২৬ মার্চ শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম। জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে শরণখোলাবাসীকে সংগঠিত করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সুন্দরবনে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পাক-হানাদার ও রাজাকারদের সঙ্গে লড়াই করেন। তার নেতৃত্বে একাধিক হামলায় বহু পাকিস্তানি সেনা সদস্য নিহত হয়। রাজাকাররা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে তার সাহসী কার্যক্রম। তার ভাই হেমায়েত উদ্দিন খানও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তার সঙ্গে। অপর দুই ভাই শাফায়েত খান ও সায়েদ খান পাকিস্তান আর্মির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১১ জুলাই সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আনোয়ার হোসেন শরণখোলা থানা ঘেরাও করেন। পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছোঁড়ে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালায়। দুইপক্ষের গুলির মধ্যে ক্যাপ্টেন আনোয়ার গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলে মারা যান। তার মরদেহ সহযোদ্ধা শেখ সামসুর রহমান ও মনিরুজ্জামান বাবুল গোপনে নৌকায় করে বাড়িতে পৌঁছে দেন। রাত ১২টায় বলেশ্বর নদীর তীরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। সেনা বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় বিবাহ করলেও কোনো সন্তান ছিল না তার। যার ফলে মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীও অন্যত্র চলে যান।

ক্যাপ্টেন আনোয়ারের ভাই হেমায়েত উদ্দিন খান মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের কেউ খোঁজ নেয় না। এর মধ্যে বলেশ্বর নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয় তার কবর। 

২০১৫ সালে স্থানীয় সংবাদকর্মী নজরুল ইসলাম আকনের দাবির প্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের দেহবাশেষ তুলে উপজেলা শহীদদের কবরস্থানের অদূরে সমাধিস্থ করেন। কিন্তু এরপর ওই সমাধি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সহযোদ্ধা শেখ সামসুর রহমান বলেন, তারা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তার নেতৃত্বে শরণখোলা থানা ঘেরাও করা হয়। ওই সময় সম্মুখযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তার মরদেহ খুব গোপনে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন সামসুর রহমান। 

মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জেল হোসেন, পঞ্চায়েত ও হারুনুর রশীদ জানান, আনোয়ার হোসেন শরণখোলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক এবং প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সমাধিস্থল নির্মাণ এবং মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ অবদান রাখায় তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করার দাবি জানান।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া আনোয়ার হোসেনের বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন ভাইয়ের কথা শুনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সেনাবাহিনীর অফিসার পদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশের জন্য শহীদ হলো আনোয়ার। আজ তার নাম নেই। মুক্তিযুদ্ধের কোনো অনুষ্ঠানেও কেউ তার নাম উচ্চারণ করে না। মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের ষড়যন্ত্রের শিকার ক্যাপ্টেন আনোয়ার।

শরণখোলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার এম এ খালেক খান বলেন, সুন্দরবন কেন্দ্রিক শরণখোলা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন। তিনি সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। তৎকালীন ৯নং সেক্টরের সাব-সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদাসিনতার কারণে এ শহীদের নাম-নিশানা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। তাকে ভুলে যাওয়া, তার কবরস্থান হারিয়ে যাওয়া জাতির জন্য লজ্জার। তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা খেতাব দেয়া উচিৎ।

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরদার মোস্তফা শাহিন জানান, শহীদ ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। তার প্রতি অবহেলা দেখানোর সুযোগ নেই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা নিয়ে বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

 

বাগেরহাট/আলী আকবর টুটুল/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়