ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

অবসর জীবনে মুক্তিযোদ্ধা আসালত আলীর আক্ষেপ

শাহীন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৫, ২৫ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অবসর জীবনে মুক্তিযোদ্ধা আসালত আলীর আক্ষেপ

আসালত আলীর বয়স এখন ৭৫। কুলিগিরি করতে করতে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ তাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তার সাথের অনেকে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেও বেঁচে থেকে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তার অনেককিছুই পূরণ হয়নি বলে মনে করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

দেশের প্রায় সবস্থানে অনিয়ম, দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্য আসালত আলীকে ভীষণ পীড়া দেয়। ছেলেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার পাশ করিয়েও টাকার জন্য চাকরি দিতে না পারার যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে এই মুক্তিযোদ্ধাকে।

চাটমোহর পৌর সদরে মুক্তিযোদ্ধা আসালত আলীর বাড়িতে বসে কথা হয় তার সাথে।

আলাপকালে জানান, ১৯৪২ সালে চাটমোহর উপজেলার বোঁথড় গ্রামে দাদার বাড়িতে জন্ম তার। পিতা মৃত মনির উদ্দিন প্রামানিক করতেন কৃষিকাজ। ৬ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে আসালত আলী সবার বড়। বোয়াইলমারী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৬৯ সালের দিকে চাটমোহর পৌর সদরে কুলিগিরি করতেন।

একাত্তরের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে পাক মিলিটারিরা চাটমোহরে ঢুকে মহাজনদের গুদামে আগুন ধরিয়ে দিয়ে লুটপাট চালায়। সেই ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমি ঠিক থাকতে পারিনি, বলেন মুক্তিযোদ্ধা আসালত।

তিনি বলেন, ‌‘৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণে উজ্জীবিত হই মুক্তিযুদ্ধে যেতে। দিন-রাত পায়ে হেঁটে চলে যাই ভারতের জলঙ্গী শরনার্থী শিবিরে। সেসময় আমার সাথে ছিলেন চাটমোহরের বোঁথড় গ্রামের আরেক মুক্তিযোদ্ধা বলাই ঘোষ (বর্তমানে তিনি মালদহে থাকেন) ও ঢাকার তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর সেখান থেকে কেচুয়াডাঙ্গা গিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে ভর্তি হয়ে দুই মাস ও পরে জামশেদপুর আমবাগান ক্যাম্পে আরো দুই মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেখান থেকে দার্জিলিং পানিঘাটা ক্যাম্পে ২১ দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর আমাদের তরঙ্গপুর নিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয় ভারতীয় আর্মিরা।’

আসালত জানান, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র গ্রহণ শেষে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ তারা একসাথে ১৭ জন আবার জলঙ্গী হয়ে দেশে প্রবেশ করেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তাদের পাঠানো হয় চাটমোহরে। তাদের তৎকালীন কমান্ডার ছিলেন এম আই চৌধুরী ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আফজাল হোসেন। চাটমোহর, হান্ডিয়াল, তাড়াশ, নওগাঁ, খানমরিচসহ বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধে অংশ নেন আসালত। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে তাড়াশ থানার নওড়গায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। মধ্যরাতে বাঙ্কার কেটে অবস্থান নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আসালতসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা। নৌকার মাঝিরা তাদের খাবার সরবরাহ করতেন।

তিনি বলেন ‘সকাল সাতটায় যুদ্ধ শুরু হয়ে চলে সকাল নয়টা পর্যন্ত। ওই যুদ্ধে প্রায় সাত শ পাক বাহিনী নিহত ও ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়। এর চারদিন পর হান্ডিয়াল ক্যাম্পে অবস্থানকালে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালালে ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর হরিপুরের গোপালপুর ক্যাম্পে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা আসালতসহ ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা। সেখানকার কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজের নেতৃত্বে চাটমোহর থানা আক্রমণ করেন তারা। কারণ থানা দখল করে অবস্থান করছিল পাক সেনারা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দুই পাকসেনা নিহত ও একজন গুলিবিদ্ধ হয়।

টানা চারদিন থানা ঘিরে রাখার পর আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় পাক বাহিনী। দেশ স্বাধীনের চারদিন পর ২০ ডিসেম্বর চাটমোহর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সালের ৮ এপ্রিল চাটমোহরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে চৌকিদার চাকরিতে যোগ দেন। পরে সেখান থেকে প্রমোশন পেয়ে মেকানিক হন। ১৯৮৬ সালে আটঘরিয়া উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মনোয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন আসালত আলী। দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে সংসার তার। বড় ছেলে আনোয়ার হোসেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর চাকরি না পেয়ে স্বর্ণকারের দোকানে কাজ করছেন। ছোট ছেলে মনিরুজ্জামান হিমেল এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মেঝো মেয়ে শিরীনা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।

অবসর জীবনে বড় ছেলের চাকরি না হওয়াই তার বড় আক্ষেপ। আসালত বলেন, ‘বড় ছেলেকে এত কষ্ট করে ডিপ্লোমা পাশ করালাম, অথচ তাকে একটি চাকরি নিয়ে দিতে পারলাম না। অনেকের কাছে ধর্না দিয়েছি, কিন্তু টাকা না দেয়ায় চাকরি হয়নি। সবক্ষেত্রে টাকা ছাড়া এখন আর কোনো কাজ হয়না। এ সমাজের একজন মেম্বারও টাকা খায়। সবই দেখি, শুনি, বুঝি, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনা। কারণ বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, তোমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। ন্যায়-অন্যায় তোমরা বলতে যাবে না। এটা বলবে প্রশাসন ও সমাজের মানুষ। বঙ্গন্ধুর সেই কথাই মেনে চলছি।'


পাবনা/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়