ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এখনও শরীরে তার যুদ্ধের ক্ষত

অরিন্দম মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০১, ২৭ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এখনও শরীরে তার যুদ্ধের ক্ষত

বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন। নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৫৬ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের কোল ঘেঁষে ধামইরহাট উপজেলার অবস্থান। উমার ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষকের সন্তান আফজাল হোসেন। তিনি এখন ধামইরহাট উপজেলা পৌর শহরের দক্ষিণ চকযদু টিএন্ডটি মহল্লার বাসিন্দা।

একাত্তরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া লাখো মুক্তি সেনাদের তিনি একজন। ৭১-এর উত্তাল মার্চের কথা।  ঢাকা শহরের মতো সারা দেশেই পাক সেনাদের চলছে তাণ্ডব। নওগাঁর সীমান্ত ঘেঁষা উপজেলা ধামইরহাটও এ থেকে রক্ষা পায়নি। এলাকার মানুষের  অধিকাংশই তখন সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।  সদ্য পাস  করা গ্রাজুয়েট আফজাল হোসেন দাঁড়িয়ে দেখছেন সে দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে যদি যেতেই হয়, তবে ফিরে আসব ট্রেনিং নিয়ে।  রুখব পাক সেনাদের।  কিন্তু ভাবনাটা বাস্তবে রূপ পাবার আগেই ছোট্ট বাজারে হানা দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী।  উপায়ন্তর না দেখে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে আত্রাই নদীতে লুকিয়ে কাটান সারাদিন।  তারপর কাউকে না জানিয়েই যুদ্ধযাত্রা। 

আফজাল হোসেন ১৯৪৬ সালে নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চকযদু (কাশিয়াডাঙ্গা) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃত ফারাজ উদ্দিন মন্ডল।  আফজাল হোসেন নওগাঁর করনেশান হাই স্কুল (বর্তমানে নওগাঁ জেলা হাইস্কুল) থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি, নওগাঁর বিএমসি কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে আইএসসি এবং নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু এলাকার মানুষের সেবা করার কথা চিন্তা করে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন।  পরে মাতৃভুমির স্বাধীনতার জন্যে ছুটে যান মুক্তিযুদ্ধে।  ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রথমে ৭নং সেক্টরে বাঙালিপুর কেম্পে ভর্তি হন।  ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের জলপাইকুড়ি জেলার মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে যোগদান করেন।  তিনি সেক্টর কমান্ডার রউফের অধীনে যুদ্ধ করেন।  বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ  কৃতিত্ব দেখান তিনি।  নওগাঁর ধামইরহাট, রাঙ্গামাটি, ফার্শিপাড়া, হিলি, চৌঘাট ডাঙ্গি এলাকার পাকহানার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের দিকে প্রথমে পাকিস্তানি সৈনিকের (পাজ্ঞাবি) তাড়া খেয়ে বাড়ি হতে কমপক্ষে ৫ মাইল দূরে আত্রাই নদীতে পানির নিচে মাথা বের করে ডুবে থাকেন। পরদিন বাড়ি ফিরে ধামইরহাট উপজেলার শেষ সীমানা আলতাদিঘীর পূর্ব পাড়ে পালিয়ে যান। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন।  তারপর ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পিতা-মাতাকে না বলে বাঙ্গালিপুর ইযুথ ক্যাম্পে ভর্তি হন। পরদিন সেখানে ভর্তি হয় আরো কয়েকজন।  তারা হলেন—আব্দুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অনেকেই। সেখানে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবুল আজাদ।  এক মাসের ট্রেনিং দেওয়ার পর ১০০ জনের একটি টিমকে আর্মি ভ্যানে জলপাইগুড়ি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়।  সেখানে মেজর রেড্ডীর অধীনে ট্রেনিং করেন।  জলপাইগুড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে ১৫ দিন পর সবাইকে বিমানে করে দার্জিলিং বিমান ঘাটিতে নিয়ে যায় এবং পরের দিন উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া দেরাদুন নামক স্থানে এক মাস ট্রেনিং হয় মেজর মালহুতরা ও মেজর চোয়ানের অধীনে।

ট্রেনিং শেষে আফজাল হোসেন, আব্দুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অন্তত ৫০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধাদের ধামইরহাট এলাকার কালুপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়। এবং বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর চৌঘাট ডাঙ্গী নামক স্থানে যুদ্ধের অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আত্রাই নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে শত্রুর অবস্থানের দিকে এগোতে থাকেন। এমন সময় তার মাথার ওপর দিয়ে গুলি হচ্ছিল ঠিক তখন তিনি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় বাম হাতটি ভেঙে যায় এবং বাম পায়ের হাঁটুর নিচে সামান্য গুলির ছটা লাগে। এখন সেই হাতটি ভালো হলেও আজও বাঁকাই আছে।  পায়ের গুলির দাগটি এখনও চিহ্ন বহন করে। এভাবে এগোতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত ঐ সময় সামনা সামনি যুদ্ধে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার প্রানের বন্ধ লোকমানের দেহ। একই সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিকও মারা যায়।  তার অল্প কিছু দিন পর দেশ স্বাধীনের আভাস শুনতে পান।  তখন ছিল ১৪ ডিসেম্বর তার ২দিন পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিজয়ের কথা জানতে পারেন। 

ধামইরহাটে পাক বাহিনীর দুর্গে আঘাত হানার পেছনে অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে অবিস্বরণীয় ভূমিকা রেখেছেন আফজাল হোসেন। তিনি বর্তমানে নিজ বাড়িতে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন। যখনই যাকে কাছে পান তখনই বলতে থাকেন ৭১-এ ফেলে আসা সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা।  আফজাল হোসেন এখনও বেঁচে আছেন শরীরে যুদ্ধদিনের সেই ক্ষত নিয়ে।  বেঁচে আছেন শহীদ লড়াকু সব মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে।



ধামইরহাট (নওগাঁ)/ অরিন্দম/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়