ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘করোনারে চিনি না, শুনতেছি দেশে আইছে’

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪১, ৪ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘করোনারে চিনি না, শুনতেছি দেশে আইছে’

‘আমরা দ্বীপ এলাকার মানুষ। করোনারে চিনিও না, জানিও না। শুনতেছি বিদেশ থেকে নাকি এদেশে আসছে। সকাল-বিকেল মাইকিং করতেছে। এখন এটার জন্য কী করতে হবে?-তা জানতে চাই।’

করোনাভাইরাস সম্পর্কে নিজের অভিমত এভাবে ব্যক্ত করছিলেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৭০ বছর বয়সি বৃদ্ধ আব্দুস সামাদ।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটিঘাটে বসে ছিলেন ৬০ বছর বয়সি রফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা অশিক্ষিত মানুষ। দিনে আনি, দিনে খাই। এই দিয়ে আমাদের কোন রকম সংসার চলে। এখন ভাইরাস আসলে আমাদের কী হবে? আগে তো আমাদের পেটে ভাত দিতে হবে। তার জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের কাজ দরকার। জাহাজ বন্ধ থাকলে আমরা কাজ করবো কোথায়? কাজ না হলে খাবো কী? না খেলে তো আর করোনার জন্য পেট বসে থাকবে না।’

দেশের সর্বদক্ষিণের দ্বীপ সেন্টমার্টিনে বাস করেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। যাদের মধ্যে অধিকাংশই অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র। বিশ্বে মহামারি এখন করোনাভাইরাস। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই দ্বীপের বাসিন্দাদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, মাস্ক কিংবা হ্যান্ড গ্লাভস ছাড়াই অবাধে ঘুরছেন দ্বীপের বাসিন্দারা। দোকানপাট বন্ধ থাকলেও নেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোন ব্যবস্থা। কাজ বন্ধ থাকায় একে অপরের সঙ্গে আলাপচারিতা আর দুষ্টুমিতে মেতে আছেন সবাই। আবার বিভিন্ন স্থানে দলবেধে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন অনেকে। আবার অনেকে পেটের চিন্তায় কী করবেন তা ভাবছেন।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম বিচের বাসিন্দা জমির উদ্দিন বলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে রেডিওতে শুনছি, বিশ্বে অনেক মানুষ এতে মারা যাচ্ছে। কিন্তু এখন আমরা কী করবো? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এ নিয়ে আমাদের কেউ কিছু বলেনি। শুধু সকাল বিকাল মাইকে কী কী কয়? এসব আমরা অতো বুঝি না।’

আরেক বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘দ্বীপে এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটক কিংবা মানুষজন আসছেন না। মানুষ আসলে তো করোনাভাইরাস আসবে। এখন জাহাজগুলো বন্ধ। আল্লাহ রহমতে আমাদের কিছু হবে না।’

এদিকে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোন ধরণের প্রস্তুতি নেই সেন্টমার্টিন দ্বীপে। এখানে ১০ শয্যার নামেমাত্র একটি হাসপাতাল থাকলেও সেখানে নেই স্বাস্থ্য সেবার তেমন কোনো ব্যবস্থা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে ৩টি ভবন রয়েছে। সেখানে কাউকে দেখা যায়নি। হাসপাতালের গেইটটি খোলা রয়েছে। আর হাসপাতাল প্রাঙ্গণে গরু-ছাগল ও কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দ্বীপের বাসিন্দা সিরাজ বলেন, ‘এখানে হাসপাতাল থাকলেও কোন ডাক্তার কিংবা নার্স থাকেন না। একজন ডাক্তার আছেন কিন্তু তিনি হাসপাতালে আসেন না, বাজারে ফার্মেসি খুলে বসে থাকেন। মাঝে মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসলে ডাক্তার ও নার্স আসেন। এছাড়া, তাদেরকে হাসপাতালমুখী হতে দেখা যায় না।’

এদিকে, দ্বীপটি মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি যদি এখনে অনুপ্রবেশ করে আর তার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায় তবে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ বলে মনে করছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূর আহমদ।

নূর আহমদ বলেন, ‘দ্বীপের মানুষের হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার ওপর কোনো আস্থা নেই। এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না থাকলেও যদি ডাক্তার থাকতেন তাহলে মানুষের আস্থা কিছুটা হলেও থাকতো। কারণ হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের কোন আলামত দেখা দিলে অন্তত: ডাক্তারের পরামর্শ মানুষ নিতে পারতেন। কিন্তু এখানে তো তাও হবে না। তাই এটা নিয়ে আতঙ্কে আছি।’

সেন্টমার্টিন দ্বীপের খুবই কাছাকাছি মিয়ানমার জানিয়ে নূর আহমদ বলেন, ‘যদি মিয়ানমার থেকে কোনো করোনা আক্রান্ত রোগী প্রবেশ করে তখন দ্বীপের মানুষের অবস্থা খুবই ভয়াবহ হবে।’

তাই, দ্বীপে বাইরের কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আরো কঠোর হবার অনুরোধ করেন তিনি।

এদিকে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের মানুষেকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে ছুটে আসে নৌ-বাহিনীর জাহাজ বঙ্গবন্ধু, নিভয় ও নির্মূল।

বানৌজা-বঙ্গবন্ধু অধিনায়ক ক্যাপ্টেন তানজিম ফারুক জানান, সীমান্তে সম্মিলিতভাবে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি করোনাভাইরাস সম্পর্কে দ্বীপবাসীকে সচেতন করা হচ্ছে। বিশেষ করে, দ্বীপের অসহায় মানুষদের খাদ্য সহায়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি করোনাভাইরাস আক্রান্ত কাউকে পাওয়া যায় তাহলে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম পাঠানো হবে।

উল্লেখ্য, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১৪’শ পরিবার থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে সহায়তা পেয়েছেন মাত্র দুইশ’ হতদরিদ্র মানুষ।


রুবেল/বুলাকী

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়