ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মুখ থুবড়ে পড়েছে কুমিল্লার পর্যটন শিল্প

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ১৫ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
মুখ থুবড়ে পড়েছে কুমিল্লার পর্যটন শিল্প

উপমহাদেশের প্রাচীন শহর কুমিল্লা। এখানে রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ বহু দর্শনীয় স্থান। এগুলোর বেশিরভাগই জেলার লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এর মধ্যে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর অন্যতম।

স্বাভাবিক সময়ে ঐতিহ্যের পাদপীঠ শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য লোকসমাগম হয়। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকে পিকনিক ও শিক্ষা সফরে আসা দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে স্থানটি।

দেশি পর্যটকের জন্য শালবন বিহারে নির্ধারিত প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা, শিক্ষার্থীদের বেলায় মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঁচ টাকা, বাংলাদেশ বাদে সার্কভূক্ত দেশগুলোর পর্যটকের জন্য ১০০ টাকা ও অন্যান্য বিদেশি পর্যটকের জন্য ২০০ টাকা। টিকিট, বুকলেট বিক্রি, গাড়ি পার্কিং, পিকনিক স্পট, বিশ্রামাগারসহ বিভিন্ন খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।

এরই ধারাবাহিকতায় বিগত কয়েক বছর ধরে পর্যটনের এই স্থানগুলোতে পর্যটক ও রাজস্ব আয়ের সূচক ঊর্ধ্বমূখী হলেও করোনার প্রভাবে এবারের চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত। করোনার আগ্রাসনে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও বিপর্যস্ত। করোনার প্রভাবে দেশের পর্যটন শিল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারা দেশের মতোই প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ শালবন এলাকাও স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়েছে কুমিল্লার পর্যটন শিল্প।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হিসেব অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক দশকে কুমিল্লার শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে প্রায় ৪৯ লাখ দেশি পর্যটক ও ১১ হাজার ১২১ জন বিদেশি পর্যটক এসেছেন। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে রাজস্ব আয় হয়েছিল এক কোটি ২২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছিল এক কোটি পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯১ টাকা।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের পয়লা জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে দেশীয় পর্যটক এসেছেন ছয় লাখ ৫৮ হাজার ২২২ জন এবং বিদেশি পর্যটক এসেছেন এক হাজার ৬৭ জন। ওই অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে এক কোটি পাঁচ লাখ ৪৩ হাজার ৮১৫ টাকা। এদিকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে করোনা পাল্টে দিয়েছে সব হিসেব।

আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘‘শীতকালে বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে দর্শনার্থীদের পদচারণা বেশি থাকে। এসময়ে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় হাজার লোকের সমাগম ঘটে। বিভিন্ন দিবস ও বিশেষ দিনে এ হার দিগুণ হয়ে যায়।
 


২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে এখান থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। তবে, ক্রমবর্ধমাণ দর্শনার্থীদের পদচারনা থেকে ধারণা করা হচ্ছিলো এবছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে দেড় কোটিতে উন্নীত হবে। অথচ এই অর্থবছরে করোনার কারণে সব হিসেব পাল্টে দিয়েছে। অর্থবছর শুরু হয়ে মাঝ পাথে তা থমকে দাঁড়ায়। অর্থাৎ করোনার প্রাদুর্ভাবের কারনে চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে সারা দেশেই পর্যটন শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে।”

হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালের পয়লা জুলাই থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত শালবন এলাকায় ছয় লাখ ৪৯ হাজার ৬৭১ জন দেশীয় এবং এক হাজার ১৬৩ জন বিদেশি পর্যটক পরিদর্শন করেছেন। এ সময়ের মধ্যে রাজস্ব আয় হয়েছে ৯৮ লাখ ১৬ হাজার ৪৪৪টাকা।

ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘‘বিগত বছরগুলোর তুলনায় এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকাংশে বাড়ানো হয়েছে। পর্যটকদের উন্নত সেবার বিষয়টিও দিন দিন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এমনকি শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরের পাশাপাশি ইটাখোলা মুড়াকেও এবছর থেকে টিকিটের আওতায় আনা হয়েছিলো। অথচ করোনার কারণে পর্যটন শিল্পটি একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। তাই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না এ বছর।

‘তবে, করোনাকালেও আমরা বসে নেই। এই প্রথম প্রত্ন এলাকার খালি যায়গায় আমরা শীতকালীন সবজীর বাগান করেছিলাম।”

ময়নামতির শালবন বিহার ও জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাফিজুর রহমান বলেন, ‘শালবন বৌদ্ধবিহার ও জাদুঘরের পর্যটকদের সেবা ও নিরাপত্তা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। যতোদিন না করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, ততদিন এ স্থানটি পর্যটক শুন্যই থাকছে।’

একই অবস্থা লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ী এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা পার্কগুলোরও।

লালমাই লেক ল্যান্ডের স্বত্বাধিকারী মীর মফিজুল ইসলাম ও ডাইনো পার্কের পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা কুমিল্লা অঞ্চলে আসা পর্যটকদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বাইরেও বাড়তি বিনোদনের কথা বিবেচনা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছি। করোনার প্রভাবে এখন পথে বসার উপক্রম।’

প্রসঙ্গত, কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতির পাদদেশ কোটবাড়িতে অবস্থিত শালবন বিহার। প্রায় ৩৭ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত শালবন বিহারটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার। সমতল ভূমি থেকে যার উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট।

বৌদ্ধ রাজাদের সময় সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে এ বিহার স্থাপিত হয়। এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে বেরিয়ে আসে বহু মূল্যবান প্রত্নবস্তু। এসব প্রত্নবস্তু রাখা হয়েছে শালবনের পাশেই অবস্থিত ময়নামতি জাদুঘরে। যেখানে রয়েছে অসংখ্য পুরাকীর্তি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান দু’টি।

শুধু শালবন নয়, কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে বহু প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নস্থল। ৭ম থেকে ১২ শতকের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে এখানে।
 


এগুলোর অন্যতম এই শালবন বিহার। মূলত এটি একটি বৌদ্ধ বিহার। বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। কোটবাড়িতে অবস্থিত শালবন বিহার ময়নামতি অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি।

অষ্টম শতকে নির্মিত এ বিহারটি। এখানে খননের পর ৫৫০ ফুট এলাকাজুড়ে একটি বৌদ্ধবিহারের ভূমি নকশা উন্মোচিত হয়। খননে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির নিদর্শন থেকে জানা যায়, দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রী ভবদেব খ্রিস্ট্রিয় অষ্টম শতকে এ বিহার নির্মাণ করেন। তখন বিহারটির নাম ছিল ভবদেব মহাবিহার। এর বিপরীত পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘নব শালবন বৌদ্ধ বিহার’।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ ময়নামতি ও লালমাই পাহাড় এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। তখন ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ের প্রত্নস্থলে ৫০টির অধিক ‘সাংস্কৃতিক ঢিবি’ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্য থেকে ২৩টিকে প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইতোমধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এখানে ২৩টি পুরাকীর্তি চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়াও খননের বাকী রয়েছে আরও বহু পুরাকীর্তি।

এ পুরাকীর্তিগুলো সব সময় দর্শনার্থীদের কাছে প্রিয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ময়নামতি জাদুঘর, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, শ্রীভবদের মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলা মুড়া, রানী ময়নামতি পাহাড়, ভোজবিহার ও হাতিগাড়া মুড়াসহ বিভিন্ন বিহার।

এসব খননকালে পুরোনো দিনের অনেক মূল্যবান পুরাসামগ্রীর খোঁজ পাওয়া গেছে।

 

কুমিল্লা/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়