ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

জামালপুরের বানভাসি এলাকাগুলোতে ত্রাণের হাহাকার

সেলিম আব্বাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০২, ১৭ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
জামালপুরের বানভাসি এলাকাগুলোতে ত্রাণের হাহাকার

সুফিয়া বেগম (৫০)। জামালপুরের ইসলামপুর সদর উপজেলার শংকরপুরে তার বাড়িতে কোমর পানি। ডুবে গেছে উঠান, টিউবয়েল, রান্নাঘর এমনকি রান্না করার চুলাও। 

স্বামী আব্দুল করিম (৬৫) রিকশা চালিয়ে পরিবারের ৬ জনের মুখে আহার যোগাতো। বার্ধক্যের ভারে তিনিও এখন ঘরে। চেয়ে চিন্তে মানুষের সহযোগীতায় দিন চলছিল। এখন সে অবস্থাটিও নেই।

দ্বিতীয় দফার বন্যায় সপ্তাহকাল ধরে বন্যার পানিতে ভাসলেও জুটেনি সরকারি-বেসরকারি কোন সাহায্য। কোমর পানিতে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও পেটতো মানছেনা সুফিয়া বেগমের পরিবারের লোকজনের। একবেলা আধাপেট খেয়ে কোনমত বেঁচে আছেন তারা।

শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সুফিয়া বেগম বলেন, ‘বাবা পানিতে পইরা আছি ৭দিন ধইরা। মেম্বর চেয়ারম্যান কেউ আমগো খোঁজও নেই নাই। স্লিপ ছাড়া সাহায্য দেয় না। স্লিপের নিষ্টিতে নাম তুলতে নোক নাগে। আমগো নোকও নাই আমরা সাহায্য পাইনা। আশাপাশ থাইক্যা এর উনু থাইকা চাইয়া নিয়্যা একবেলা আধাপেট খাই, কোন সময় না খাইয়া দিন পার করতাছি। আমগো সাহায্যর ব্যবস্থা কইরা দিয়ে জীবনডা বাঁচান।'

একই ইউনিয়নের কাঁচিহারা মৃত আব্দুল করিমের ছেলে ৬০ বছর বয়সি মাঝি টল্লু মিয়া কথা বলতে গেলেই ক্ষেপে উঠেন। রাগান্বিত কন্ঠে বলেন, ‘আফনাগো সঙ্গে কতা কইয়া নাভ কি? আফনেরা আইছেন,ফটো তুলবেন,নিউজ করবেন সরকার সাহায্য পাঠাবো হেই সাহায্য চেরম্যান মেম্বাররা মাইরা খাবু।'

উচ্চস্বর নামিয়ে তিনি পরক্ষনেই বলেন, ‘কি হুনবেন, ৫দিন ধইরা আমার বাড়িত পানি। ঘরে ৪জন খাওইয়ে। ঘরে কোমর পর্যন্ত পানি। চকির পায়ার নিছে ইটের উপর ইট দিয়ে বউ পুলাপান নিয়া আছি। মাঝে মধ্যে পানির ধাক্কায় চহি নড়বড় করে। বাড়ির চারপাশেও পানি। খাইয়া না খাইয়া পইরা আছিলাম। আইজ বাইর ওইছি বউ পুলাপানের মুহে খাওন জুঠাতে। আরেক জনের নৌকা নিয়া মানুষ পারাপার করতাছি। মেম্বর চেরম্যান কি দেখবু গরিবেরে, আল্লাও দেহেনা।' 

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একই গ্রামের আরেক বানভাসি মাসুদ রানা (২৬)। তিনি ঝাঁলমুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবারের চারজনের ভরণপোষণ যোগাতেন। চারপাশে পানি উঠায় ঝাঁলমুড়ি বেঁচাবিক্রিও কমে গেছে। এক দেড়শ টাকা কামাই করাও কঠিন। চাল কিনতে গেলে সবজি কিনার টাকা থাকেনা। ঘরে পানির উপর মাচা করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। মাচার উপর আলগা চুলা বসিয়ে রান্না করছে, যা জোটাতে পারছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে রানা মিয়ার পরিবারের। সরকারি ত্রাণ রানা মিয়ার কপালেও জোটেনি। 

সুফিয়া,টুল্লু মিয়া, মাসুদ রানার মতো ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি, বেলগাছা, সাপধরী ও নেয়ারপাড়া ই্উনিয়নের বিভিন্ন বন্যা দুর্গত এলাকা ঘুরে এলেই দেখা যায় পানিবন্দি মানুষের মানবেতর জীবনচিত্র।

বন্যায় ভাসছে জামালপুর। দু’দফা বন্যায় ২৩ দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৬লাখ মানুষ। দেখা দিয়েছে তীব্র ত্রাণ সংকট। পেটের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে দিশেহারা বানভাসিরা ত্রাণের আশায় ছোটাছুটি করছেন দিগ্বিদিক। 

যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র'র পানি বেড়ে জামালপুর জেলার ৭টি উপজেলার ৫১টি ইউনিয়ন ও ৮টি পৌরসভার ৬২৫টি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাই বন্যা কবলিত। এসব গ্রামের ২লাখ ১৬ হাজার ৬’শ ৫৫টি পরিবার বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। ত্রাণের জন্য পানিবন্দিদের মাঝে চলছে হাহাকার। কিছু কিছু এলাকায় সরকারি ত্রাণ বিতরনের খবর পাওয়া গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। প্রতিবারের বন্যার মতো এবার করোনা পরিস্থিতির জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও সাহায্য নিয়ে আসছে না। 

সাপধরী উনিয়নের কাশারীডোবা গ্রামের বাসিন্দা গণমাধ্যম কর্মী আজিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এবারের বন্যায় পুরো সময়টা আমি গ্রামের বাড়িতে আছি। পর পর দু’দফা বন্যায় খাদ্যের অভাবে পানিবন্দি মানুষজন কাহিল হয়ে পড়েছে। চারপাশে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। এই ইউনিয়নের কোন গ্রামে সরকারি ত্রাণ তৎপরতা আমার চোখে পড়েনি। শুধু দু:স্থ এইড বাংলাদেশ নামে একটি এনজিওকে কিছু মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরন করতে দেখেছি।' 

এদিকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী বললেন, ত্রাণের কোন সংকট নেই। জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ভান্ডারে পর্যাপ্ত ত্রাণ মওজুদ রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌছে যাবে বলে তীব্র ত্রাণ সংকটের মুখেও দাবি করেছেন তিনি ।

তিনি বলেন, এপর্যন্ত ৩১০ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১২ লাখ টাকা ৫০ হাজার টাকা, ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং শিশু খাদ্যের জন্য ২লাখ ও গো-খাদ্যের জন্য ২লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

বন্যাকবলিত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা বলছেন, বন্যা আক্রান্ত মানুষের তুলনায় বরাদ্দ খুবই কম পেয়েছেন তারা। 

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘দুই দফায় বন্যা চলছে। আমার ইউনিয়নের পুরোটাই বন্য কবলিত। এবার দ্বিতীয় দফায় ৩টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। চল্লিশ হাজার শুধু ভোটারই। শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ মিলে লোকসংখ্যা আরো তিনগুণ হবে। বন্যা কবলিত বিশাল জনগোষ্ঠির মাঝে বরাদ্দের অল্প ত্রাণ দিয়ে কি হয়? কয়জনকে দিবো?' 

বন্যা আক্রান্ত সাপধরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদিনও বলেছেন একই কথা। তিনি জানান, তার ইউনিয়নে ২০টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। প্রথম দফা বন্যায় ৬টন ও দ্বিতীয় দফা বন্যায় ২টন পেয়েছি। এই অল্প ত্রাণ বন্যা দুর্গত সব এলাকায় দেয়া সম্ভব হয়নি। মাত্র তিনটি গ্রামে ত্রাণ বিতরন করেছেন তিনি।

 

জামালপুর/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়