ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাগরে মাছ ধরতে আর চাঁদা দিতে হচ্ছে না কলাপাড়ার জেলেদের 

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৪, ৩১ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১৯:০৯, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাগরে মাছ ধরতে আর চাঁদা দিতে হচ্ছে না কলাপাড়ার জেলেদের 

সাগরে মাছ ধরতে, জাল ফেলতে গাতা বা নির্ধারিত এলাকার জন‌্য প্রভাবশালী সিন্ডিকেটকে এবার আর টাকা দিতে হচ্ছে না জেলেদের। জেলেরা সমুদ্রের বদলে স্থানীয় প্রেসক্লাবে বিক্ষোভ করা কদিনের মধ‌্যেই পুলিশ তৎপর হয়ে চাঁদাবাজি বন্ধ করেছে। জেলেদেরই স্থানীয় সংগঠনের নিজেদের নেতা এবং রাজনৈতিক ব‌্যক্তিদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামের পর এখন তারা সাগরে নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারছেন।

কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলে আসছিলো গাতা (মাছ ধরার জন্য জাল ফেলার নির্দিষ্ট এলাকা) বিক্রি। গত এক দশক ধরে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সমুদ্রে জেলেদের মাছ ধরার সীমানা নির্ধারণের নামে চলছিলো টাকা আদায়। এ নিয়ে গত ২৪ আগস্ট ১৯টি খুটা জেলে নৌকার প্রায় অর্ধশতাধিক জেলে কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করলে টনক নড়ে প্রশাসনে। পরে জেলেদের দীর্ঘ এ সমস্যা সমাধানে গত ২৬ আগস্ট (বুধবার) রাত সাড়ে ৮টায় কুয়াকাটার পর্যটন করপোরেশনে দুই শতাধিক জেলেদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করে কলাপাড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী আহম্মেদ।

সভায় ভূক্তভোগী জেলেরা সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি, সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায়, সীমানা নির্ধারণ নিয়ে স্বজনপ্রীতি, সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে সমুদ্রে মাছ ধরতে না দেওয়াসহ হয়রানির নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। পাশাপাশি আশার আলো জেলে ও মৎস্যজীবী সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় কুয়াকাটার লেম্বুরচর থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত গড়ে ওঠা ছয়টি ইউনিট কমিটি বাতিলসহ সাগরে নির্বিঘ্নে জাল ফেলে মাছ শিকারের দাবি জানান। এসময় পুলিশ সুপার আহমদ আলী বলেন, সমুদ্রে কোন দস্যুতা, চাঁদাবাজি, মাস্তানী ও দলীয় প্রভাব বিস্তারের সূযোগ নেই। যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জেলেদের আশ্বাস দেন। পরে পুলিশ সুপারের এমন আশ্বাসে জেলেদের দীর্ঘ এ সমস্যার সমাধান হয়।

জেলেদের সূত্রে জানা যায়, কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন জেলার উপকূলীয় এলাকার প্রায় অর্ধলক্ষাধিক জেলে। ট্রলারের লাইসেন্স আর মৎস্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোন কাগজপত্র প্রয়োজন না হলেও বিগত দশ বছর ধরে সমুদ্রে মাছ ধরার সীমানা র্নিধারণ নিয়ে চলেছিলো রমরমা বানিজ্য। কুয়াকাটা ও লতাচাপলীর একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গাতা প্রতি এক মৌসুমের জন্য জেলে প্রতি দিতে হতো পাঁচ থেকে বিশ হাজার টাকা। এতে প্রতি মৌসুমে জেলেদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হতো কয়েক লাখ টাকা।

জেলেদের অভিযোগ, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা এই সিন্ডিকেটের কাছ থেকে গাতা না কিনে জাল পাতলে লুট করে নেওয়া হতো মাছ, কেটে দেয়া হতো জাল। নিয়ে যাওয়া হতো ট্রলারের ইঞ্জিন। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকে হয়েছেন শারীরিক নির্যতনের শিকার। বিষয়টি কলাপাড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে বন্ধ হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে জেলেদের মাঝে।

ভুক্তভোগী জেলে শহীদ মাঝি জানান, ‘গত বছর নাম সর্বস্ব আশার আলো মৎস্যজীবী সমিতির মাধ্যমে গঠিত সিন্ডিকেটকে দশ হাজার টাকা দিয়ে সমুদ্রে জাল ফেলেছি। এবছরও ৫ নং জেলে ইউনিটের সভাপতি আ. রব হাওলাদার, সম্পাদক জাহাঙ্গীরসহ ওই কমিটির বেশ কয়েকজন টাকা চেয়েছিলো। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে আর টাকা দিতে হয়নি। 

আরেক জেলে আমির হোসেন মাঝি বলেন, ‘এখন আর সমুদ্রে কোন ভয় নেই। কোন সমস্যাও নেই। সব সমস্যা স্যারে (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) সমাধান করে দিছে।’ 

নুর সাইদ মাঝি বলেন, ‘স্থানীয় মতি, হালিম মাঝি ও কালামের চাঁদাবাজিসহ স্বেচ্ছাচারিতায় ভরা মৌসুমেও মাছ শিকার করতে পারছিলাম না। এখন আর কেউ গাতা বিক্রির কথা বলেনা। নির্বিঘ্নে মাছ শিকার করতেছি।'

এলাকাবাসী সাদ্দাম মাল বলেন, ‘প্রশাসনের দৃঢ় পদক্ষেপে সাগরের জলদস্যুতা থেকে জেলেরা মুক্তি পেলেও গাতা সিন্ডিকেটের নতুন কৌশলে নির্যাতন ও হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পায়নি জেলেরা। তবে এবার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে চাঁদাবাজি কিছুটা কমেছে।’

আশার আলো মৎস্যজীবি সমিতি সভাপতি নিজাম শেখ বলেন, ‘সাগরে জাল পাতা নিয়ে প্রায়শই দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটত। তাই ৬টি ইউনিট কমিটির মাধ্যমে ১৪০ হাত পরপর খুটা বসিয়ে জাল পাতার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় ইউনিট কমিটিকে। সীমানা র্নিধারণের সময় ট্রলার প্রতি প্রকারভেদে তেল খরচ বাবদ ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা নেওয়া হতো। তবে ইউনিট কমিটি এর বাইরেও জেলেদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতো। তবে এখন থেকে কেউ চাঁদাবাজি করলে প্রশাসনের মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করা হবে।’ 

কলাপাড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহম্মদ আলী জানান, ‘সিন্ডিকেট করে জেলেদের কাছ থেকে চাদা আদায়ের কোন সুযোগ নেই। এ নিয়ে জেলেদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছি। বর্তমানে সমুদ্র এলাকা প্রশাসনের নজরে রয়েছে। তারপরও যদি কেউ জেলেদের কাছে চাঁদা দাবি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হইবে।  

কলাপাড়া/ইমরান/সাজেদ  

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়