ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিকাশ এখন রিকশা চালান ঢাকা শহরে

মোসলেম উদ্দিন, হিলি (দিনাজপুর) সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:৩৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
বিকাশ এখন রিকশা চালান ঢাকা শহরে

শ্রী বিকাশচন্দ্র দাস। শ্রীহীন জীবনে ‘শ্রী’ ফেরাতে লড়াই করছেন। একটু ভালো করে, আরেকটু স্বস্তিতে বেঁচে থাকার আশায় নেমেছেন রাজপথে। সেই কবে, বাবা তপন দাস বলেছিলেন, ‘মন দিয়ে পড়াশোনা কর। মনে রাখিস- লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে।’ বিকাশচন্দ্রের কথাটা মনে ধরেছিল। স্কুল পেরিয়ে কলেজেও উঠেছিলেন। কিন্তু স্নাতক শেষ বর্ষে এসে হোঁচট খেলেন। কৃষক বাবার সাধ আছে সাধ্য নেই। ঘরে বিবাহযোগ্য দুই মেয়ে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা- করোনা। মাঠে কাজ নেই। ঘরে চালের হাঁড়ি শূন্য। দিন আর চলে না!

করণীয় বুঝতে না-পেরে বিকাশ একদিন উঠে পড়লেন ঢাকাগামী বাসে। মনে আশা, যদি একটা চাকরি মেলে! কিন্তু ‘সোনার হরিণের’ সন্ধান বিকাশ এখনও পাননি। এদিকে দিনে দিনে বাড়ে দেনা। তরুণ প্রাণে জেঁকে বসে হতাশা। বাড়ি ফিরে যাবেন সে উপায়ও নেই। তার দিকে তাকিয়ে পুরো পরিবার। অথচ বিকাশ কারো চোখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারেন না। যদি ‘না’ শুনতে হয়। কতো জনেই তো আশ্বাস দিয়েছে, হয়নি কিছুই। এমন সময় এগিয়ে আসেন কাকা স্বপন সাহা। একদিন সকালে কাকার গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে বিকাশচন্দ্র বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। ‘আমি গাড়ি-ঘোড়ায় চড়তে না পারি, আমার গাড়িতে এখন অনেকেই চড়ে।’ কথাগুলো বলার সময় বিকাশের চোখের কোণে কি জল জমেছিল? ভালো করে লক্ষ্য না করলে সেই অন্তর্জালা বোঝা যায় না। 

বিকাশের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বাড়ি গ্রামে। বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। ২০১৩ সালে এসএসসি এবং ২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। নিজেই বললেন, ‘রেজাল্ট খুব ভালো হয়নি। কারণ পড়ার পরিবেশ বা সুযোগ সহজ ছিল না।’ সহপাঠীরা যখন প্রাইভেট পড়ায় ব্যস্ত বিকাশকে তখন জীবনের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় কাজ করতে হয়েছে- বললেন সে কথাও। অর্থের কারণে বড় বোনকে বিয়ে দিতে পারেননি। বাবার বয়স হচ্ছে, দেহের সঙ্গে মনের জোর ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। এমন প্রতিকুলতার মধ্যেও বিকাশ পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কথা কখনও ভাবেননি। ২০১৬ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। বাংলায় পড়ার কারণও আছে। যাতে প্রাইভেট পড়তে বাড়তি খরচ করতে না হয়- জানালেন বিকাশ।

অভাবের মধ্যে দিয়েই বড় হওয়া উল্লেখ করে বিকাশ বলেন, ‘নিজের দুঃখ-কষ্ট মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু মা-বাবার কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না। তাছাড়া আমি এখন বড় হয়েছি, সুতরাং দায়িত্ব তো নিতেই হবে।’ আর এ কারণেই বিকাশের ঢাকায় আসা। ঢাকার সব কিছুই তার অচেনা। তবে ধীরে ধীরে চিনছেন রাজধানীর অলিগলি। সেইসঙ্গে চেনা হয়ে যাচ্ছে জীবন!

কথা হয় বিকাশের বাবা শ্রী তপন দাসের সঙ্গে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সংসারে এখন আয়-রোজগার নাই। নিজের শরীরের ওপর দিয়ে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছি। ওদের চাহিদা ঠিকমতো পূরণ করতে পারিনি। বিকাশ নিজের চেষ্টায় আজ এতো দূর লেখাপড়া করেছে। স্কুল, কলেজের টাকা দিতে পারতাম না। ছেলেটা আমার খেয়ে না খেয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে বইপত্র চেয়ে এনে লেখাপড়া করেছে।’

এদিকে এক বুক আশা নিয়ে ঘরে দিন গুনছেন বিকাশের মা গীতা রানী সাহা। তিনি বলেন, ‘বিকাশ ঢাকা গেছে, চাকরি করার জন্য। আমার ছেলে অনেক ভালো লেখাপড়া করে; ওর ভালো চাকরি হবে।’ স্বামীর পক্ষে এখন আর আগের মতো পরিশ্রমের কাজ করা সম্ভব নয়। বিকাশ চাকরি করে টাকা পাঠালে সংসারের অভাব দূর হবে বলেও তিনি আশাপ্রকাশ করেন।

‘রিকশা চালিয়ে কতো আয় হয়?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিকাশ সময় নেন। ধীর কণ্ঠে বলেন, ‘জীবনের প্রথম রিকশা চালাচ্ছি। এখনও অভ্যাস হয় নাই পুরোপুরি।’ এরপর হঠাৎ করেই চঞ্চল শোনায় বিকাশের কণ্ঠ। টুং টাং বেল বাজিয়ে চলন্ত রিকশার সামনে থেকে সবাইকে যেমন সরিয়ে দিতে হয়, বিকাশ জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলো সেভাবে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই সম্ভবত আপন মনে বলেন- ‘এতো দিন মানুষকে রিকশা চালাতে দেখেছি, আজ আমি নিজেই একজন রিকশাওয়ালা।’

এরপর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিকশায় উঠে বসেন বিকাশচন্দ্র সাহা। দ্রুত হাতে বেল বাজিয়ে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়