ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

খরস্রোতা নরসুন্দা এখন মরাগাঙ

রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৪, ৬ নভেম্বর ২০২০  
খরস্রোতা নরসুন্দা এখন মরাগাঙ

নরসুন্দা নদী, কিশোরগঞ্জ (ছবি: রাইজিংবিডি)

এককালের খরস্রোতা নরসুন্দা নদী এখন মরাগাঙ। প্রায় ৫৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ‌্যের নদীটি পাকুন্দিয়ার সীমানার নিকট ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যদিকে ইটনা উপজেলার বাদলার নিকট ধনু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। 

হোসেনপুর উপজেলার কাওনায় বাঁধ দেওয়ার পর নদীটি প্রাণ হারিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, বাঁধ দেওয়ার ফলে একদিকে যেমন নদীকে হত‌্যা করা হয়েছে, অন‌্যদিকে ময়লা-আবর্জনা পড়ে নদী ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।  ফলে পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি হয়েছে। 

নরসুন্দা উদ্ধারে সরকার এগিয়ে আসে ২০১২ সালে। নদীকেন্দ্রিক শহর নির্মাণে নেওয়া হয় ব্যাপক পরিকল্পনা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেকের বৈঠকে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়, ‘নরসুন্দা নদী পুনর্বাসন ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভা সংলগ্ন এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’।

তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০১২ সালের ২২ নভেম্বরে বৃহৎ এ প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন। দরপত্রের কার্যাদেশ অনুযায়ী, প্রকল্পের কাজের মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বরাদ্দ আসে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা। পরে আরেক দফা বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ১১৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালে। কিন্তু এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে দুই দফা সময়। পরে ২০১৬ সালের জুন মাসে কোনো রকমে গোজামিল দিয়ে কাজ শেষ করে কর্তৃপক্ষ।  শুধু নদী খননে অনিয়ম নয়, অবকাঠামোর কাজের মান নিয়েও স্থানীয়দের অভিযোগ। 

পানি প্রবাহের জন্য ৩৩ কিলোমিটার নদী খনন করা হলেও, নরসুন্দা ব্রহ্মপুত্র থেকে পায়নি পানি।  আর নদীতে পানি না আসায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নরসুন্দা।  স্থানীয়রা বলছেন, পরিকল্পনায় গলদ ছিল বলেই এমনটি হয়েছে। 

প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নদী খনন করে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে নরসুন্দায় পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা। আর ওই চলমান নদীকে ঘিরে শহরকে সুন্দরভাবে সাজানো। এজন্য শহরে ছয় কিলোমিটার নদীর পার সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা, ছোট-বড় মিলিয়ে ১০টি দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মাণ। ওয়াকওয়ে, দুটি পার্ক, মুক্তমঞ্চ, সুউচ্চ নদী পর্যবেক্ষণ টাওয়ারসহ আরও কিছু কাজ হাতে নেওয়া হয়।  অথচ যে নদীকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় হতাশ হয়েছে শহরবাসী। 

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর পাশে অবস্থিত শহরের বিভিন্ন ছোট-বড় বাজারের ময়লা-আবর্জনার স্তুপ-নদীর পাড়ে, ব্রিজের পাশে, নদীর পানিতে ও ওয়াকওয়েতে দিনের পর দিন ফেলা হচ্ছে।  এতে পরিবেশ ও নদীর পানি দূষণের প্রকোপ বাড়ছে।  শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি, ড্রেন ও স্থাপনার ময়লা-আবর্জনার পানি নদীতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। আর নদীর পাশে ওয়াকওয়েতে মানুষ খুব কষ্টে যাতায়াত করছে।

পরিবেশবিদ অধ্যক্ষ শরীফ সাদী রাইজিংবিডিকে বলেন, নরসুন্দা এখন সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে। তাই বর্ষায় জলাবদ্ধতা ও শুস্ক মৌসুমে চরম দুর্গন্ধের শিকার হচ্ছে শহরবাসী। নদী খননের প্রায় পুরো টাকা লুটপাট করায় নদীর তলদেশের গভীরতা ও প্রশস্তের মাপ কিছুই ঠিক নেই। এখনও সময় আছে, ব্রহ্মপুত্রের মূল প্রবাহের সঙ্গে নরসুন্দাকে যুক্ত করা হলে নদীটি প্রাণ ফিরে পাবে।

পরিবেশ রক্ষা মঞ্চের (পরম)  সদস্য সচিব বাধঁন রায় রাইজিংবিডিকে বলেন, নদীকে এখন আর নদী বলা যাবে না। এটি এখন নালায় পরিণত।  ময়লা-আবর্জনার স্তুপে কোথাও কোথাও নদীর রেখা খুঁজে পাওয়া যায় না। নদীটি কিশোরগঞ্জের দুঃখ হয়ে গেছে। 

কিশোরগঞ্জ এলজিইডির বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম আমিরুজ্জামান রাইজিংবিডিকে বলেন, আমি এ প্রকল্পের অনেক পরে এখানে যোগদান করেছি।  নরসুন্দা প্রকল্প সমাপ্তির পর একাধিক নির্বাহী প্রকৌশলী এখানে যোগদান করেছেন। তবে জেলার ৮টি পৌরসভার রাস্তাঘাট মেরামতসহ নরসুন্দা প্রকল্পের ওয়াকওয়ে মেরামত করতে নতুন একটি প্রকল্প আসছে। তখন হয়তো নরসুন্দা নদীর ওয়াকওয়ে গুলো মেরামত করা সম্ভব হবে। 

এদিকে পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ রাইজিংবিডিকে বলেন, নদীকে ঘিরে যে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে নদীর পাড় ভেঙে পড়া, নদীতে আবর্জনা, পানি ও পরিবেশ দূষণ হতোনা। প্রকল্পের নিম্নমানের কাজের দায় এখন পৌরবাসীকে বহন করতে হচ্ছে।  এমন কি এলজিইডি এখন পর্যন্ত পৌরসভার নিকট প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেয়নি। তবুও প্রায় সময়ই পৌরসভার উদ‌্যোগে আবর্জনা ও কচুরিপানা পরিস্কার করা হয়।

নরসুন্দায় পানিপ্রবাহ নিশ্চিতসহ নদীকেন্দ্রিক আধুনিক কিশোরগঞ্জ শহর গড়ে উঠবে, যেখানে নাগরিক সুবিধা, চিত্তবিনোদন, কর্মসংস্থান ও দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হবে। নদীতে পানিপ্রবাহের জন্য নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে হলেও সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চায় কিশোরগঞ্জবাসী।

কিশোরগঞ্জ/সাইফ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়