ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কুষ্টিয়ায় মৌসুমে পুড়ছে ৩ লাখ ১২ হাজার মে.টন কাঠ

কাঞ্চন কুমার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৭, ২০ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:২৬, ২০ নভেম্বর ২০২০
কুষ্টিয়ায় মৌসুমে পুড়ছে ৩ লাখ ১২ হাজার মে.টন কাঠ

নেই অধিকাংশ ইটভাটার অনুমোদন, নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। তবু কৃষিজমি দখল করে কুষ্টিয়ায় বেড়েই চলেছে ইটভাটা। প্রতি মৌসুমে পুড়ছে অন্তত ৩ লাখ ১২ হাজার মে.টন কাঠ।

কুষ্টিয়া জেলার ৬টি উপজেলার কৃষি জমিতে গড়ে ওঠা তালিকাভুক্ত ১৩৭টিসহ দুই শতাধিক ইটভাটার মালিকদের কেউই নিয়ম মেনে ভাটা স্থাপন করেননি।

এমন অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোবায়ের হোসেন চৌধুরী জানান, ভুমি জোনিং এ্যাক্ট-২০১০, কৃষি জমি সুরক্ষা আইন-২০১৫, পরিবেশ সুরক্ষা আইন-১৯৯৫সহ  ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনে আইনগত নীতিমালা-২০১৩ সবই লঙ্ঘিত হয়েছে উপজেলার সকল ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে।

সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে দেখা গেছে, ইটভাটা স্থাপনে লাইসেন্স বা ছাড়পত্র কিছুই নেই তাদের- জানান এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

আলাপকালে কুষ্টিয়ার ইটভাটা মালিক সমিতির নেতৃত্বে থাকা বশির উদ্দিন, আব্দুল হাকিম, মহিদুল ইসলাম জানান, তারা ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরেই নিয়মিত টাকা দিচ্ছেন। যদি তারা অবৈধ হন, তাহলে তাদের কাছ থেকে এসব টাকা কেন নেওয়া হচ্ছে? কেনইবা মাসে মাসে চাঁদে চাঁদে প্রশাসন অভিযানের নামে এসে জরিমানা আদায় ও ভাটা ভাংচুরসহ নানাভাবে তাদের আর্থিক ক্ষতি সাধন করছেন? তারাও চাইছেন, এর একটা সঠিক সমাধান হোক।

মিরপুর উপজেলার বাড়–ই পাড়া ইউনিয়নের এক ইটভাটা মালিক জানান, ৫লাখ ইটের ধারণ ক্ষমতাসহ একটি ভাটা স্থাপনে অন্তত: ২৫-৩০বিঘা জমির প্রয়োজন হয়। এরপর ইট তৈরি, শুকানো ও মাটির প্রয়োজনে কমপক্ষে আরও ৫বিঘা জমি লাগতে পারে। এই সব জমির মালিকানা তো ভাটামালিকের নিজস্ব নয়, কিছু জমি লিজও নেওয়া হয়।

মিরপুর উপজেলার এমআরবি ইটভাটা মালিক শরিফুল ইসলাম মুকুল বলেন, এক গাড়ি কয়লা কিনতে লাগে ৪ লাখ টাকা।  একসাথে নগদ এতো টাকা দিয়ে কয়লা কিনে ভাটা চালানোর ক্ষমতা কারো নেই। তাছাড়া বেশি দামের কয়লা পুড়িয়ে এক রাউন্ডে যে উৎপাদন পাওয়া যায় তার চেয়ে সহজে প্রাপ্ত কম দামের কাঠ পুড়িয়ে উৎপাদন বেশি পাওয়া যায়। তাই বে-আইনি জেনেও তারা কাঠ পোড়াচ্ছেন। বে-আইনি বলেই মাঝে মধ্যে প্রশাসন আসে, তারপর যা করার তাই করে চলে যায়।

সদর উপজেলার এমএফবি ইটভাটার মালিক মহিদুল ইসলাম বলেন, কি করার আছে? কাঠ পোড়ানো বে-আইনি, তবুও উপায় নাই। সবাই এভাবেই ইট পোড়াচ্ছেন। ভাটাগুলোতে বে-আইনি কাঠ পোড়ানো হয় বলেই তো সবাই এসে সুবিধা নিয়ে যায়। প্রশাসন থেকে শুরু করে সাংবাদিক ও নেতারা পর্যন্তও নানাভাবে সুবিধা নিয়ে থাকেন।

কেএইচবি ভাটার মিস্ত্রী রাজু মিয়া বলেন, কাঠ পুড়িয়ে ইটের উৎপাদন ভালো হয়। কয়লা পোড়ালে মোট ইটের তিন ভাগের মধ্যে এক ভাগ ইট নষ্ট হয়ে যায়। সমানতালে পোড়ে না। সে কারণে কাঠ পোড়ানো হয়। ৫ লাখ ইটের একটি ভাটায় প্রতিদিন প্রায় ৪শ মন বা ১৬ মে.টন কাঠ পোড়ানো হয়। এক রাউন্ড ইট পোড়াতে ২২/২৩ দিন সময় লাগে। বছরের ইট পোড়ানো মৌসুমে ৫ মাসে প্রতি ভাটায় কমপক্ষে ৫ রাউন্ড করে ইট পোড়ানো হয়।

পরিবেশবিদ গৌতম কুমার রায় জানান, ১৩৭টিসহ প্রায় দুই শতাধিক ইটভাটায় এক মৌসুমে গড় ৫ রাউন্ডে ১৩০দিন ধরে ইট পোড়ানো হয়। প্রতি ১টি ভাটায় ১দিনে ১৬ মে.টন কাঠ পুড়লে এক মৌসুমে কাঠ পোড়াচ্ছেন ২০৮০ মে.টন। জেলার সবগুলি ইটভাটার হিসেব মতে, প্রায় ৩ লাখ ১২ হাজার মে.টন কাঠ পুড়ছে ভাটাগুলোতে।

পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার সিনিয়র কেমিস্ট মিজানুর রহমান জানান, জেলায় মাত্র ৪২টি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া থাকলেও অন্যদের কোন ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। কিভাবে এসব ভাটা চলছে তা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বলতে পারবেন। তবে এসব অবৈধ ভাটা মালিকদের সাথে পরিবেশ অধিপ্তরের কারো সাথে কোন অনৈতিক সম্পর্ক নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপপরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান জানান, জেলার বেশিরভাগ ইট ভাটারই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। চিমনির উচ্চতাও সঠিক নেই। অবৈধ এসব ইটভাটা উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনের সাথে আলোচনা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে অভিযান শুরু করা হবে। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এক দশকে জেলার তিন ফসলী ৭৫ হাজার ৮শ ৮০হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে ২শ ৮৮হেক্টর জমিতে গড়ে উঠা ইটভাটা প্রত্যক্ষভাবে ধ্বংস করেছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) ড. হায়াৎ মাহমুদ জানান, নানাবিধ কারণে কৃষি জমি ধ্বংসের ফলে খাদ্য উৎপাদন শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে উঠছে। 

অনুমোদন ছাড়াই ভাটা মালিকরা সবাইকে ম্যানেজ করে, কৃষি জমিতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নীতিমালা লংঘন করছে- সম্প্রতি পরিচালিত অভিযানে ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন জানান দুদক কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক হাফিজুল ইসলাম।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো: আসলাম হোসেন জানান, জেলায় ভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে ভাটা মালিকরা নীতিমালা লংঘন করে এসব করছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ ইচ্ছে করলেই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারবেন না। কৃষি জমিকে অকৃষি দেখিয়ে ইটভাটা হয়েছে- এমন অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুষ্টিয়া/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়