ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ঋণের বোঝা ৪০ হাজার: ৭৫ বছরেও থেমে নেই তিনি 

রফিক সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৪, ২৫ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ০৩:১৯, ২৬ নভেম্বর ২০২০

আব্দুস সোবহান সুবু। বয়স ৭৫। এই বয়সে মানুষ নাতি-পুতি নিয়ে অবসর যাপন করে। কিন্তু এনজিও থেকে নেওয়া ৪০ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধের চাপ আর দুটি মানুষের পেট চালাতে অবসরের কথা ভাবতেও পারেন না সুবু।

এই বয়সেও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। সকালে ইট ভাঙেন, বিকেলে ফুটপাথে পিঠা বিক্রি। এই দুটি পেশাকে সম্বল করে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ঋণ শোধের প্রত‌্যয়ে লড়ে চলেছেন।

মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারান সুবু। ছয় সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন সুবুর মা। মাকে সাহায‌্য করতে কাজে নেমে পড়েন সুবু। এছাড়া পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় না চাইতেই দায়িত্ব ঘাড়ে চেপে বসে তার। ছোট্ট সুবু তখন থেকেই জীবন সংগ্রামী। স্থানীয় একটি রাইস মিলে কাজ শুরু করেন। সেই শুরু।

শত অভাব আর টানা পোড়েনের মধ‌্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভাই-বোনেরা বড় হয়ে ওঠে। বোনের বিয়ে হয়ে যায়। অপর চার ভাই গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌর এলাকার ৬নং ওয়ার্ডের খঞ্জনা গ্রামের জমি জমা বেচে ভাগ বুঝে নিয়ে চলে যান। সুবুর কাছে পড়ে থাকেন মা। 

টানা ২৭ বছর ধরে রাইস মিলের শ্রমিক হিসেবে কাটিয়ে দেন সুবু। অবশেষে বন্ধ হয়ে যায় মিলটি। শুরু হয় সুবুর নতুনভাবে জীবন যুদ্ধ। ইট ভাঙার কাজ শুরু করেন। এরপর জীবনে শুরু হয় নতুন অধ‌্যায়। বিয়ে করেন তিনি। 

বিবাহিত জীবনে চার মেয়ে ও দুই ছেলের বাবা হন। চার মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। মেয়েটি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বেশিরভাগ সময়ই থাকে লাপাত্তা। বাকী তিন মেয়ে ও দুই ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলের একজন সৌদি প্রবাসী। অন্যজন স্থানীয় একটি ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করেন। 

ছেলে-মেয়েরা একরকম ভালোই আছে, শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েটি ছাড়া। তবে তাদের কেউই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজ রাখে না। তাই পড়ন্ত বেলায় এসেও সকাল-সন্ধ্যা হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছেন সুবু। 

ছোট বেলায় লেখাপড়া করার প্রবল আগ্রহ ছিল। দারিদ্রতা আর সংসারের চাপে তা হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে ছিল সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন। তাও হলো না। ছোট মেয়ে তাসলিমার আগ্রহ ছিলো। তাকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করিয়েছেন। ওই পর্যন্তই। তারপর মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়।

ভিটে-মাটি বলতে আছে মাত্র এক কাঠা জমি। বছর দেড়েক আগে বাকী জমিজমা বিক্রি করে এক ছেলেকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। সেই ছেলেও কোনো খোঁজ রাখেন না। এরপর শুরু হলো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। অনেকদিন কাজহীন হয়ে থাকতে হয়েছে। ধারদেনাও কিছুটা বেড়েছে।

বর্তমানে বাড়ির যে জমিটুকু আছে, বর্ষাকালে তা পানিতে তলিয়ে যায়। বসবাসের অযোগ‌্য হয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ খাবার পানিরও সংকট। এসব সমস‌্যা সমাধানের জন‌্য স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেন সুবু। 

সেই টাকার কিছু দিয়ে বাড়িতে একটি সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করেন। বাকী টাকায় বালু ভরাট করে বাড়ির যায়গাটুকু উঁচু করেন। সেই ৪০ হাজার টাকার প্রতি সাপ্তাহের কিস্তি হিসেবে দিতে হয় এগারোশো’ টাকা করে।

সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ইট ভেঙে আয় হয় ১৫০/২০০ টাকা। বিকেলে পিঠা বিক্রি করে লাভ হয় ১০০/১৫০ টাকার মতো। সব মিলিয়ে প্রতিদিন তার রোজগার প্রায় ৩০০ টাকা। এ দিয়েই চলে স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসার এবং এনজিও’র সাপ্তাহিক কিস্তি। 

সুবু বলেন, ‘মাথার ওপর ঋণের বোঝা। ঋণ পরিশোধের জন্য আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ইট ভাঙি। আর বিকেলে রাস্তার পাশে বসে পিঠা বিক্রি করি। এ থেকে উপার্জন খুব বেশি হয় না। সাপ্তাহিক কিস্তি শোধ করার পর যা থাকে, তাই দিয়ে কোনোমতে চলি। কবে চলে যাব তার কোনো ঠিক নেই। আল্লার কাছে একটাই চাওয়া, যাওয়ার আগে যেনো ঋণ শোধ করে যেতে পারি।’

সন্তানরা যে খোঁজ খবর রাখে না তা নিয়েও কোনো আক্ষেপ নেই সুবুর। তিনি বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক পরিশ্রম করেছি ভাই-বোনেদের জন‌্য। তারা কিছুই মনে রাখেনি। নিজের সন্তানরাও মনে রাখেনি। এ নিয়ে আফসোস করে কী হবে বলেন? একা এসেছি, একা চলেও যাব। দুঃখ হয় আমার স্ত্রী আর প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে নিয়ে। ওরা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়বে।’

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) / সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়