ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের সময়েও শিরোমণিতে চলছিল ‘সম্মুখ যুদ্ধ’

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৬, ২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১০:৩০, ২ ডিসেম্বর ২০২০
পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের সময়েও শিরোমণিতে চলছিল ‘সম্মুখ যুদ্ধ’

খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের সামনে নির্মিত ‘মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমর স্মৃতিস্তম্ভ’

পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করলেও ঠিক ওই সময় একটি বৃহৎ প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা।

খুলনার শিরোমণিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিত্র বাহিনীর এই সম্মুখ যুদ্ধের কারণে খুলনা শত্রুমুক্ত হয় বিজয় দিবসের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর। শিরোমণির এ যুদ্ধকে বলা হয় ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’।

স্থানটি খুলনা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে শিরোমণিতে অবস্থিত। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধের বীরত্বগাঁতা ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতে খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের সামনে শোভা পাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমর স্মৃতিস্তম্ভ’।

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর কমান্ডার হায়াত খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। মার্কিন সপ্তম নৌবহর আগমনের খবরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতেই হায়াত খান এমন সিদ্ধান্ত নেন। যশোর সেনানিবাসকে তিনি নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে পারছিলেন না। তাদের বিশাল ট্যাংক রেজিমেন্ট, পদাতিক সেনা, রাজাকার বাহিনীর বিশাল শক্তি নিয়ে খুলনার শিরোমণি এলাকায় জড়ো হয়। ৭ ডিসেম্বর তারা খুলনার শিরোমণি, আটরা, গিলাতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর ও শোলগাতিয়া এলাকার একাধিক স্থানে ক্যাম্প গড়ে তোলেন। তার মধ্যে জনশূন্য শিরোমণি এলাকায় কমান্ডার হায়াত খান সবচেয়ে বড় ক্যাম্প গড়েন এবং মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে থাকেন।

পাকবাহিনীর কমান্ডার হায়াত খান তার সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ব্রিগেড নিয়ে খুলনা শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম এলাকা জুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাছাড়া, আটরা থেকে শিরোমণি এলাকার যশোর রোডে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রস্তুতি নেয়। ঠিক এমনই সময় ফুলতলার চৌদ্দ মাইলে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মেজর গণির নেতৃত্বে একটি বড় কনভয় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করেও কোনো সাড়া না পেয়ে এবং তাদের নীরবতা দেখে ১৪ ডিসেম্বর খুলনার দিকে রওনা হয়। মিত্রবাহিনী খুলনার শিরোমণি এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রের নিশানার মধ্যে পৌঁছালে পাকবাহিনীর বিভিন্ন দিক থেকে অতর্কিত হামলার স্বীকার হয়। ওই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সামনে থাকা বিপুল সংখ্যক সেনা হতাহত হয়, তবে প্রচণ্ড ক্ষতির পরও কিছু সংখ্যক সেনা ফুলতলার চৌদ্দ মাইল ক্যাম্পে ফিরে যেতে সক্ষম হয়।

এদিন মিত্রবাহিনীর বিমান ভুল করে ফুলতলা থেকে অগ্রসরমান মিত্র সেনাদের পাকিস্তানি সৈন্য মনে করে তাদের ওপর বোমা বর্ষণ করে। ফলে মিত্র বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ট্রাক ভরে ভারতীয় সেনাদের মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখে স্থানীয় লোকজন। পরবর্তী সময়ে মিত্রবাহিনী তাদের পরিকল্পনা বাতিল করে নতুন ভাবে ঢেলে সাজায়।

ফুলতলার চৌদ্দ মাইল ক্যাম্প থেকে মিত্রবাহিনী মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর এবং ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল যৌথভাবে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। মেজর মঞ্জুর সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদাকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ-কৌশল তৈরি করেন। বটিয়াঘাটার চক্রাখালি মাধ্যমিক স্কুল থেকে মেজর জয়নাল আবেদিনের (স্বাধীনতা পরবর্তী ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) নেতৃত্বে গল্লামারি রেডিও সেন্টার অভিমুখে আক্রমণ শুরু হয়। রেডিও সেন্টারে নিরাপত্তার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের আগ থেকেই পাঞ্জাবি সেনারা মোতায়েন ছিল। পাকিস্তানী বাহিনী ১৭ ডিসেম্বর সকালে রেডিও সেন্টার ক্যাম্পে অস্ত্র সমর্পণ করে এবং মেজর জয়নাল আবেদীন ও লে. গাজী রহমতউল্লাহ দাদু (বীর প্রতীক) সকাল ৯টায় যৌথভাবে সার্কিট হাউজে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।

মিত্র বাহিনীর অপর একটি ইউনিট ইস্টার্ন জুট মিল গেট এলাকা দিয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে শিরোমণির ঠিক পূর্বপাশে অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে গোলা ছুড়তে থাকেন। ওই সময় মেজর মঞ্জুর তার বাহিনীকে নিয়ে ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর দুই দিন ধরে বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে শিরোমণির সীমিত অবস্থানে ঘিরে ফেলেন।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও হায়াত খান তা না মেনে তার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন সেই ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং চার সহস্রাধিক সেনা। ওই রাত থেকেই মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক সম্মুখ সমর। মেজর মঞ্জুর রাতের অন্ধকারে লুঙ্গী পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে খালি পায়ে মাথায় গামছা বেঁধে শ্রমিকের বেশে দুই হাতে দুইটা স্টেনগান নিয়ে অসীম সাহসের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি ট্যাংক বহরের ভেতরে, প্রতিটা ট্যাংকের ভেতরে খুঁজে খুঁজে একজন একজন করে গানম্যানকে হত্যা করে স্তব্ধ করে দেয় পাকিস্থানি ট্যাঙ্কবহরকে। সারারাত ধরে চলা যুদ্ধে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির মুখে এক পর্যায়ে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে পর্যুদস্ত পাকবাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং শিরোমণি নসু খানের ইটভাটার কাছে মিত্রবাহিনী-মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে।

এরই প্রেক্ষিতে ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বেলা দেড়টায় সার্কিট হাউস মাঠে লিখিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর ও ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের বেল্ট ও ব্যাজ খুলে নিয়ে আত্মসমর্পণের প্রমাণাদিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। বর্তমানে এ যুদ্ধের কাহিনী সিলেবাস আকারে আন্তর্জাতিক মিলিটারি একাডেমিতে পড়ানো হয়।

এই যুদ্ধের স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গিলাতলা সেনানিবাসের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। ২০১০ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম (অব.) খুলনা-যশোর রোডের গা ঘেঁষে গিলাতলায় (জাহানাবাদ) স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

খুলনার শিরোমণি সম্মুখযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী খানজাহান আলী থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার স ম রেজওয়ান আলী বুধবার (২ ডিসেম্বর) রাইজিংবিডিকে জানান, ভয়ঙ্কর এ যুদ্ধের কারণে ফুলবাড়ীগেট থেকে আটরা ইস্টার্নগেট পযন্ত বেশ কয়েকটি গ্রাম জনশূন‌্য হয়ে পড়ে। স্থানীয় গ্রামবাসী নিরাপদে আশ্রয় নেন।

শিরোমণি বাজার, বাদামতলা ও এর উল্টো দিকে বিসিক শিল্প নগরী ঘিরে কমবেশি চার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এমন কোনো গাছ বা ভবন ছিল না যেটি অক্ষত ছিল। প্রতিটি গাছ ও ভবনে শত শত গুলি ও শেলের আঘাতের চিহ্ন ১৯৮০-৮১ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ওইসব গাছ-পালা ও ঘরবাড়ি দেখে শিরোমণি যুদ্ধের ভয়াবহতা আন্দাজ করা যেত। এখনও বিদ্যুতের বিভিন্ন পোলে গুলির চিহ্ন রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি আরও জানান,  মূলযুদ্ধ ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল শিরোমনি শহীদ মিনার সংলগ্ন কেডিএ মার্কেটের সামনে। কিন্তু সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। হয়েছে সেনানিবাসের সামনে। তবে, স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র এই শিরোমণি কেডিএ মার্কেটের সামনে সরকার একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যেই স্থানও নির্ধারণ করা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট এবং প্রস্থ ৬৫ ফুট। যেখানে কামান ও ট্যাংকসহ এ যুদ্ধের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস থাকবে বলেও আশা করছেন তিনি।

খুলনা/বুলাকী

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়