ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কুড়িগ্রামে বাড়ছে শীত: দুশ্চিন্তায় চরাঞ্চলের হতদরিদ্ররা

বাদশাহ সৈকত, কুড়িগ্রাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ৪ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ০৯:১৩, ৪ ডিসেম্বর ২০২০
কুড়িগ্রামে বাড়ছে শীত: দুশ্চিন্তায় চরাঞ্চলের হতদরিদ্ররা

বাদশাহ্ সৈকত : শীত বাড়তে শুরু করেছে দেশের উত্তারাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায় নভেম্বরের শুরু থেকেই এ জেলার তাপমাত্রা নিম্নগামী হতে শুরু করেছে। 

দিনের তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করলেও রাতের তাপমাত্রা নেমে আসছে ১৫ থেকে ১৩ ডিগ্রিতে। এ অবস্থায় শীতকষ্টে ভুগতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষেরা।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিসের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সুবল চন্দ্র সরকার জানান, ডিসেম্বর মাসে দুটি শৈত্য প্রবাহ হতে পারে। সেসময় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমারসহ ১৬টি নদ-নদী বেষ্টিত এ জেলায় প্রায় সাড়ে চার শতাধিক চরাঞ্চল রয়েছে। এ চরাঞ্চলগুলোয় প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। যার বেশিরভাগই হতদরিদ্র। 

বার বার নদ-নদীর ভাঙনের শিকার এসব পরিবারে আয়ের তেমন উৎস নেই। তাই শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় গরম কাপড় কিনতে পারেন না এরা। ফলে প্রতি বছর শীত এলেই তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়।

এছাড়াও জেলা শহরের অভ্যন্তরে পিটিআই ও ছয়আনির বস্তিতে প্রায় দুই শতাবিক পরিবার বসবাস করে। এসব বস্তিতে বসবাসরত পরিবারগুলোর বেশির ভাগ মানুষ ছোট ছোট ব্যবসা ও শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। শীতকালে তাদেরও কষ্ট বাড়ে।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার দুর্গম চরাঞ্চলের নাম মশালের চর। চরটিতে প্রায় চার শতাধিক পরিবারের বাস। এ চরের মানুষের পেশা কৃষি, গবাদি পশু পালন ও মাছ ধরা। প্রতি বছর বন্যা, খরা ও শীত মোকাবেলা করে অতিকষ্টে দিন যাপন করেন তারা।

মশালের চরের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ‘প্রতি বছর বন্যা আর শীত এলেই আমাদের দুর্ভোগ বাড়ে। এবারও শীত পড়তে শুরু করেছে কিন্তু গরম কাপড় নেই বললেই চলে। চরে তেমন কাজকর্ম নেই, তাই রোজগারও কম। এ অবস্থায় সামান্য গরম কাপড় দিয়েই তিন সন্তানসহ পরিবারের ছয় সদস্যের দিন পার করতে হবে। প্রতিবছর সরকারিভাবে কিছু কম্বল দেওয়া হয়। তবে আমরা কখনও কোনো কম্বল পাইনি।’

একই অবস্থা জেলার নয় উপজেলার প্রত্যেকটি চরাঞ্চলের। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের মিলের পাড়ের নামদেলের স্ত্রী মিনা বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কোনো ঘর-বাড়ি নেই। অন্যের বাড়িতে থাকি। দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। সে কাজও সবসময় হয় না। ছোট দুটি ছেলে। তাদের শীতের কাপড় কেনার সামর্থ নেই।’

বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নটি পুরোটাই ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চরাঞ্চলে অবস্থিত। প্রতি বছর শীতের সময় এখানকার মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা শীতে দারুণ কষ্ট ভোগ করে। আমার ইউনিয়নে মোট পরিবারের সংখ্যা সাড়ে চার হাজার। এবার সরকারিভাবে ৪৬০ পিস কম্বল পেয়েছি। যা ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে একেবারের হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে বিতরণ করার প্রক্রিয়া চলছে।’

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলা ও উপজেলা মিলে সারথী, তারুণ্যের ঐক্যে সমাজ, গ্রীণ ভয়েস, উৎসর্গ ফাউন্ডেশনসহ মোট ২৫টির মত স্বোচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে। এ সংগঠনগুলোর বেশিরভাগ নিষ্ক্রিয়। তবে কিছু সংগঠন প্রতিবছর শীতে সহায়তার হাত নিয়ে দুর্ভোগে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ায়। 

স্থানীয় সংগঠন সারথীর নির্বাহী পরিচালক জাহানুর রহমান খোকন জানান, শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করা সারথী সংগঠনের পক্ষ থেকে এবার শীতের শুরুতেই উলিপুর ও নাগেশ্বরী উপজেলার দুটি চরে তিন শতাধিক কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গত বছর এই সংগঠনের পক্ষ থেকে সাড়ে তিন হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।

প্রতি বছর শীতে কুড়িগ্রাম সমিতি ঢাকা নিজ উদ্যোগে ঢাকার ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে কুড়িগ্রামের শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। 

সমিতির মহাসচিব মো. সাইদুল আবেদীন ডলার বলেন, ‘এ বছরও আমরা কুড়িগ্রামের শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবো। কাজ করছি। যাতে করে কিছু মানুষ হলেও গরম কাপড়ে শীত নিবারণ করতে পারে।’
এদিকে জেলায় প্রায় ৫০টি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা থাকলেও বেশিরভাগগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ডোনার পার্টি না থাকায় এবং ডোনাররা নিজেরাই কাজ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক হারুন অর রশিদ লাল বলেন, ‘জেলায় প্রায় ৫০টির বেশি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা রয়েছে। যারা বিভিন্ন দুর্যোগসহ জেলার হতদরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে আসছে। বর্তমানে ডোনার পাটি না থাকায় সবগুলো উন্নয়ন সংস্থার অবস্থা একেবারেই খারাপ পর্যায়ে। অনেকে অফিস পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছে। শুধু আমরাই কোন রকমে টিকে আছি।’

প্রতি বছর কুড়িগ্রামের তীব্র শীতের খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা কুড়িগ্রামে এসে সবমিলে দুই থেকে তিন হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকেন। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে দলীয় নেতারা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যরা নিজ উদ্যোগে কিছু কম্বলসহ কিছু শীত বস্ত্র বিতরণ করেন। কিন্তু জেলার দুর্গম চরাঞ্চলগুলোতে দূরত্ব এবং সময় বেশি লাগার কারণে শীত বস্ত্র বিতরণ করা হয় না।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘কুড়িগ্রাম যেহেতু সীমান্তবর্তী এবং নদ-নদী বেষ্টিত জেলা, সেহেতু প্রতি বছর এ জেলায় শীতের প্রকোপ একটু বেশি থাকে। এজন্য আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি- যাতে অসহায় মানুষেরা শীত কষ্টে না ভোগে। এ বছর শীতের প্রকোপ শুরু হওয়ার আগেই সরকারি বরাদ্দের ৩৫ হাজার কম্বল বিতরণের জন্য ইউনিয়নগুলোতে দেওয়া হয়েছে। যা বিতরণ প্রক্রিয়া চলছে।’ 
 

ঢাকা /সনি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়