ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নুর মোহাম্মদের লাশ দেখে শপথ নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা

সাকিরুল কবীর রিটন, যশোর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৮, ৫ ডিসেম্বর ২০২০  
নুর মোহাম্মদের লাশ দেখে শপথ নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ক্যাপ্টেন হুদাকে কেউ চোখের পানি ফেলতে দেখেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো আবেগই তাঁকে স্পর্শ করতো না। সেই মানুষটিও সহযোদ্ধা নুর মোহাম্মদের লাশ দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। এদিন অসীম সাহসিকতায় আত্মত্যাগের অনন্য নজির স্থাপন করে মৃত্যুবরণ করেন নুর মোহাম্মদ। আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠের একজন তিনি।

বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদের নামাজের জানাজা পড়ান শার্শার কাশীপুর গ্রামের মাওলানা হাবিবুল্লা। এখনও তিনি বেঁচে আছেন।

একাত্তরের ৩০ মার্চ যখন ইপিআর-এর যশোর সেক্টরের সদস্যরা বিদ্রোহ করেন, তখন নুর মোহাম্মদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বয়রা সাব সেক্টরের অধীন নুর মোহাম্মদকে সাহসিকতা এবং নেতৃত্ব গুণের জন্য একটি কোম্পানি প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঝিকরগাছার গঙ্গানন্দপুর পাকবাহিনীর ঘাঁটি থেকে কাশীপুর হয়ে বয়রা পর্যন্ত আসার রাস্তা ছিল দু’টি। একটি গঙ্গানন্দপুর-গোয়ালহাটি-আটুলিয়া-গুলবাগপুর-বেংদহ-কাশীপুর-বয়রা। অন্যটি গঙ্গানন্দপুর-বিষহরি-মৌতা-বেলতা-কাশীপুর-বয়রা। তাদের আসার দু’টি পথেই মুক্তিবাহিনীর তরফে কড়া প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। চালু রাখা হয় সার্বক্ষণিক টহল ব্যবস্থা।

কাশীপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার বয়স তখন ১৭ বছর। ৫ সেপ্টেম্বর একটি টহল দলের দায়িত্ব নিয়ে গোয়ালহাটিতে ছিলেন নুর মোহাম্মদ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া এবং মোস্তফা। আর মূল দল ছিল আরও পেছনে আটুলিয়ার দিকে। তখন পড়ন্ত বেলা। ১৫০ জনের মতো পাকসেনা ও রেঞ্জারের একটি দল গঙ্গানন্দপুর থেকে গোয়ালহাটির দিকে এগোতে থাকে ত্রিমুখী কলাম ধরে। ওদের আক্রমণের তখন কোনো বিকল্পি ছিল না। গুলি ছুড়তে ছুড়তে নুর মোহাম্মদ ও তাঁর দুই সঙ্গী নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এলএমজি ছিল নান্নু মিয়ার হাতে, শত্রুর একটি গুলি এসে লাগে তাঁর শরীরে। তিনি গুরুতর আহত হন। নুর মোহাম্মদ নিজ কাঁধে আহত সহযোদ্ধাকে তুলে নিয়ে পিছিয়ে যেতে থাকেন। গুলিও ছুড়তে থাকেন মাঝেমধ্যে শত্রুকে ঠেকাতে। এ সময় মোস্তফা কাছাকাছি এসে পড়ায় নুর মোহাম্মদ তাঁকে নির্দেশ দেন নান্নু মিয়াকে নিয়ে আরও পেছনে চলে যেতে।

এরপর নুর মোহাম্মদ বারবার অবস্থান বদল করে শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্য গুলি ছুড়তে থাকেন। শত্রু মনে করে মুক্তিবাহিনীর অসংখ্য সৈনিক তাদের প্রতিরোধ করছে। এ সময় একটি মর্টারের গোলা এসে নুর মোহাম্মদের ডান পা গুড়িয়ে দেয়। জীবন-মৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণে সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সুযোগ দিতে নুর মোহাম্মদ তার শেষ বুলেটটি পর্যন্ত খরচ করেন। তাঁর সহযোদ্ধারা নিরাপদে মূল ঘাঁটিতে ফিরে যান। এদিকে আধ ঘণ্টার তুমুল যুদ্ধ শেষে ২৩টি লাশ পিছু ফেলে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা গোয়ালহাটিতে জঙ্গলের ভেতর খুঁজে পান ল্যান্স নায়েক নুর মোহাম্মদের দেহ। হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র নুর মোহাম্মদকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেছে। তুলে নিয়েছে তাঁর দু’টি চোখ।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, নুর মোহাম্মদের লাশ পরদিন ৬ সেপ্টেম্বর কাশীপুর আনা হয় সকালে। ক্যাপ্টেন হুদা বয়রা থেকে সেখানে চলে আসেন। মাথার টুপি খুলে অভিবাদন জানান প্রিয় সহকর্মীকে। বয়রা সাব সেক্টরের সাহসী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা শিশুর মতো সেদিন দু’চোখের পানিতে বুক ভাসান। নুর মোহাম্মদের লাশ ছুঁয়ে শপথ নেন- যেভাবেই হোক গঙ্গানন্দপুর থেকে শত্রুকে হটিয়ে দেবেন। পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় কাশীপুর-বয়রা সড়কের ধারে নুর মোহাম্মদকে সমাহিত করা হয়। নুর মোহাম্মদ জানতেন মৃত্যু অনিবার্য, তবুও টহল দলের অধিনায়ক হিসেবে নিজের জীবন দিয়ে, তিনি সহকর্মীদের বাঁচিয়েছিলেন।

মাওলানা হাবিবুল্লা জানান, নুর মোহাম্মদের মাথা একটি গেঞ্জি দিয়ে বাঁধা ছিল। লাশের গোসল করানোর পর মুক্ত অঞ্চল কাশীপুর-বয়রা সড়কের পাশে পুকুরপাড়ে তাঁকে দাফন করা হয়।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়