ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

যেখানে ওয়ার্ডবয়-দালালের হাতে জিম্মি রোগীরা

এনাম আহমেদ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৩, ৯ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৯:৩১, ৯ জানুয়ারি ২০২১
যেখানে ওয়ার্ডবয়-দালালের হাতে জিম্মি রোগীরা

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক‌্যাল কলেজ (শজিমেক)  হাসপাতালে

ওয়ার্ডবয় ও দালালের দৌরাত্ম‌্যে নাজেহাল বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক‌্যাল কলেজ (শজিমেক)  হাসপাতালে রোগী ও স্বজনরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওয়ার্ডবয়দের বখসিস ও নার্সদের দুর্ব‌্যবহারে আখড়া যেন এই হাসপাতাল। আর দালালরা প্রতিনিয়তই এই হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে অন‌্য ক্লিনিকে ভর্তির করানোর প্ররোচনা দেন রোগীর স্বজনদের। চলতি বছরের (২০২১) ২ জানুয়ারি থেকে ৫ জানুয়ারি—এই ৪ দিন সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হাসপাতালে দেখা গেছে, জরুরি বিভাগের মূল গেটের সামনে সারিবদ্ধভাবে স্ট্রেচার ও হুইল চেয়ার রাখা হয়েছে। সেখানে মাস্ক ও গ্লাভস পরে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েজন যুবক। কেউ কেউ পায়চারী করছেন। তাদের কাজ হাসপাতালে আসা রোগীদের সিএনজি অথবা অ্যাম্বুলেন্স থামার পর স্ট্রেচারে করে ভর্তির জন্য নিয়ে যাওয়া। তবে, রোগী এলে স্বজনদের সঙ্গে তারা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন। এরপর রোগীকে স্ট্রেচারে তুলে ওয়ার্ডে রেখে আগের জায়গায় ফিরে আসেন তারা। 

এদিকে, জরুরি বিভাগের ভেতরে দেখা গেছে ৪-৫ জন যুবককে। তাদের হাতেও গ্লাভস। জরুরি বিভাগে রোগী ও স্বজনরা যাওয়া মাত্রই এই যুবকদের তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। রোগীর স্বজনদের পেছনে ঘুরতে থাকেন তারা। এরপর কী রোগ, কী করবে—তা জানার পরপরই সুযোগ বুঝে স্বজনদের বাগিয়ে নিতে চেষ্টা করেন তারা। তারা স্বজনদের বলেন, ‘ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসা হবে। স্যার ভালো করে দেখবেন। এখানে এই চিকিৎসা হয় না।’ 

বোনের চিকিৎসার জন‌্য মতিয়ার নামের একজন যুবক জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখেন ডাক্তার নেই। এসম দু’জন ব্যক্তি এসে রোগী সম্পর্কে জানার পর তাকে বারবার অন‌্য হাসপাতালে যাওয়ার রোগী নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আর রোগী অন‌্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে ডাক্তারের জন‌্য ৭০০ ও নিজের জন‌্য ৫০ টাকা দাবি করেন। তবে, মতিয়ার এই দালালের কথায় রাজি হননি। এতে ক্ষেপে যান ওই দালাল। তিনি মতিয়ারকে আর জরুরি বিভাগের রিসিপশনেও যেতে দেননি। 
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রোগী ভর্তি করার পর পরীক্ষা ও অপারেশনের জন‌্য ড্রেসিং করতে প্রতিবার হুইল চেয়ার বা স্ট্রেচারের প্রয়োজন পড়লে  ওয়ার্ডবয়কে দিতে হয় টাকা। এক্ষেত্রে হুইল চেয়ারের জন্য ১০০ টাকা এবং স্ট্রেচারের জন্য ২০০ টাকা দিতে হয়। 

এই হাসপাতালের ভেতরেই রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। জরুরি বিভাগে পুলিশ বাহিনীর সদস‌্যরা সার্বক্ষণিক থাকলেও দালালের তৎপরতা বন্ধের বিষয়ে তারা উদাসীন। অভিযোগ রয়েছে—পুলিশের সামনেই রোগীকে দালালরা হাসপাতাল থেকে অন‌্য ক্লিনিকে নিয়ে গেলেও তারা নির্বিকার বসে থাকেন। ‘ফাঁড়ির পুলিশকে ম্যানেজ’ করেই দালালরা হাসপাতালে নিজেদের তৎপরতা চালান বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার চন্ডিহারা গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, ‘মাথায় আঘাত পেয়েছিন। কেবিনে ভর্তি আছি। ডাক্তার ঠিকমতো আসেন না। হাসপাতালের প্রায় সব বিভাগের সবার আচরণই খারাপ। কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করে ঠিকমতো উত্তর পাওয়া যায় না। নার্সদের ব্যবহার আরও খারাপ। স্যালাইন বা ব্যাগের রক্ত শেষ হয়ে গেলে খুলে দিতে বা রোগীর প্রয়োজনে তাদের ডেকেও পাওয়া যায় না। আবার বার বার ডাকতে গেলে তারা দুর্ব্যবহার করেন।’

নার্সদের সম্পর্কে একই কথা জানিয়েছেন বগুড়ার কালিতলা এলাকার রোগীর স্বজন সেলিম মিয়া। তিনি বলেন, ‘গত ৪ দিন আগে আমার স্ত্রীর পেটে টিউমার অপারেশনের জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। নার্সদের সঙ্গে বহুবার বাকবিতণ্ডা হয়েছে। ’ 

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা আসা রোগীর স্বজন আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমার শ্বশুরকে গত ৩১ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করি। ওয়ার্ডবয়দের প্রতিবার স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ারের জন্য ওয়ার্ডবয়রা টাকা দাবি করেন। তারা টাকা ছাড়া স্ট্রেচারে হাত দেন না। আমার শ্বশুরকে ড্রেসিং করাতে হবে। এজন‌্য স্ট্রেচারের প্রয়োজন। এজন‌্য ওয়ার্ডবয় ২০০ টাকা দাবি করেন।’

নন্দীগ্রাম উপজেলার রণবাঘার গোপাল ঘোষ বলেন, ‘আমার ভাই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসে অপারেশন করাতে হয়। প্রায় দেড় মাস ভাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালে আছি। হাসপাতালে প্রবেশের সময় স্ট্রেচারের জন‌্য ২০০ টাকা দিয়েছি। ’ 

এছাড়া, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে আসা রোগীর স্বজন ও গাইবান্ধার সাঘাটা থেকে আসা রোগীর জন্য ওয়ার্ডবয়দের সম্পর্কে একই তথ্য দিয়েছেন।

দালালের দৌরাত্ম‌্য বিষয়ে ছিলিমপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আজিজ মণ্ডল বলেন, ‘মেডিক‌্যাল থাকলে দালাল থাকবেই। তবে, কম আর বেশি। তবে, রোগীরা যেন দালালের সঙ্গে কোথাও না যান, সেজন্য বারবার মাইকিং করি। গ্রাম থেকে আসা রোগীদের কেউ কেউ হয়তো বিভ্রান্ত হন। আমি এই পর্যন্ত ২৭ দালালকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছি। এখন সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। যে কারণে দালালদের দৌরাত্ম‌্য আগের মতো নেই। ’

রোগীর স্বজনের সঙ্গে নার্সের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ স্বীকার করেছেন শজিমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (সেবা) আকতার বানু। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটে। আমাদের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে নার্সদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যেন তারা রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে ‍দুর্ব‌্যবহার না করেন। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। শুধু সরকারি হাসপাতাল নয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও একই অবস্থা। এটা খুব দুঃখজনক।’

শজিমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে স্ট্রেচার নিয়ে যারা থাকেন, তাদের মধ্যে স্থায়ী কর্মচারীর পাশাপাশি খণ্ডকালীন কর্মচারীও রয়েছেন। রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির সময় স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ারের জন্য স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে, এই সংক্রান্ত ঝামেলা আছে। অনেক সময় বাইরের লোকজন এসে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। এগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। ’

স্ট্রেচার ও ড্রেসিংয়ের জন্যও স্বজনদের কাছে ওয়ার্ডবয়দের টাকা দাবি প্রসঙ্গে উপ-পরিচালক বলেন, ‘স্ট্রেচারের জন্য বাড়তি টাকা নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। তবে, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’ এসব হয়রানি বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

বগুড়া/এনই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়