ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ইটভাটায় পুড়ছে ফসলি জমি, কৃষকের কান্না শুনবে কে? 

সৌরভ পাটোয়ারী, ফেনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৫, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ০২:১৫, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ইটভাটায় পুড়ছে ফসলি জমি, কৃষকের কান্না শুনবে কে? 

ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায় অবাধে কৃষিজমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটাগুলো। আর এই কাজে সহযোগিতা করছে কিছু অসাধু মাটি ব্যবসায়ী-দালাল। এভাবে মাটি কাটায় কোনো ফসলের জমি পুকুরে পরিণত হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী জমির আইল ভেঙে পড়ছে। কমে যাচ্ছে জমির উর্বরতাও। এতে হতাশ হয়ে পড়ছেন কৃষকরা। এই বিষয়ে অভিযোগ করার পরও কৃষি বিভাগ ও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ফেনী সদর উপজেলার কাশিমপুর লঙ্কা পাওয়ার প্ল্যান্টের পাশের কৃষি জমিতে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা খুশি। কিন্তু কৃষকের সেই খুশিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাটি ব্যবসায়ী ও দালাল-চক্র। চক্রটি রাত-দিন মেশিন দিয়ে মাটি কেটে চলেছে।  

ফেনীর সদর উপজেলার উত্তর কাশিমপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রউফ, চাষী মোহাম্মদ ইলিয়াস, কৃষক মো. একরামুল হক ও উত্তর কাশিমপুর গভীর নলকূপ (সেচপাম্প) বিএডিসির স্কিম ম্যানেজার মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের কাশিমপুরে যেন মগের মুল্লুক চলছে। সরকারের গ্রামীণ সড়ক ধ্বংস করা হচ্ছে। নষ্ট করা হচ্ছে কৃষিজমি। বিএডিসির পানিসঞ্চালন লাইনের পাইপ ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ সেদিকে কর্তৃপক্ষের কোনো নজরই নেই।   

স্থানীয়রা জানান, উত্তর কাশিমপুরে গ্যাসের লাইন নির্মাণের জন্য জমি বিক্রি করে সরকারের কাছ থেকে তিনগুণ দাম নিয়েছেন জমির মালিকরা। ওইসব জমির মাটিও মেশিন দিয়ে তুলে বিক্রি করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

উত্তর কাশিমপুরের কয়েকজন কৃষক  লংকা পাওয়ার প্ল্যান্টের পাশে অর্ধশত একর জমির মাটি বিক্রি করেছেন ইটভাটায়। তাদের জমি থেকে গভীর গর্ত করে মাটি কেটে ইটভাটায়  নেওয়া হচ্ছে। এতে জমিগুলো ডোবায় পরিণত হচ্ছে।

এই বিষয়ে কৃষক আবদুর রউফ বলেন, ‘পাশের জমির মাটি বিক্রি করায় আমার রোপা বোরো ধানের জমির আইল ভেঙে গেছে। দীর্ঘ ফাটল ধরে জমির পাড় ভেঙে পড়ছে।’


এই বিষয়ে মাটি কাটার মেশিনের মালিক ফেনী সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের ছেলে মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি আর মাটি কাটার জন্য মেশিন আর ভাড়া দেবো না। জমির মূল্য থেকে মাটি বিক্রি করে অনেক বেশি দাম পাচ্ছেন মালিকরা। যে কারণে তারা লোভে পড়ে মাটি বিক্রি করছে ইটভাটায়। ফলে পাশের জমিগুলো ভেঙে পড়ে যাচ্ছে।’

সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের আবু সুফিয়ানের ছেলে পিকআপচালক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘তেহমুনীর খোকন আমার (ফেনী ধ-১১-০৯৩৮) পিকআপ প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার টাকায় ভাড়া দেন। আমি আর মাটি বহন করবো না। ’

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের উত্তর কাশিমপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আবদুল রব বলেন, ‘গত কয়েকদিন আগে বোরো আবাদ করেছি। জমিতে অনেক টাকা খরচ করে সারও দিয়েছি। পাশের জমি থেকে গভীর গর্ত করে মাটি কাটায় আমার ধানের চারাসহ জমিন ভেঙে পড়ছে।’

এই বিষয়ে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা আবদুল রব বলে, ‘যেখানে সরকার জমি চাষ করার জন্য বীজ ও সার বিনামূল্যে দিচ্ছে, সেখানে মাটি কাটার কারণে আমাদের কষ্টের ফসলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

একই অভিযোগে করেন ফেনীসদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিউয়নের বগইড় গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ওয়াহিদুর রহমানেরও। তিনি বলেন, ‘পাশের জমির ভাঙন রোধ করতে ২৫ হাজার টাকা খরচ করে বাঁধ নির্মাণ করেছি। যেভাবে মাটি কাটা হচ্ছে, এই বাঁধ টিকবে কি না, সন্দেহ। ’

সদর উপজেলার, পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন উত্তর কাশিমপুর গ্রামের আরাফাত হোসেন বলেন, ‘আমার জমির পাশে একটি তালগাছ ছিল। মাটির দালালরা ওই গাছটি উপড়ে ফেলেছে। আমরা তাদের কাছে অসহায়।’

পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের উত্তর কাশিমপুর গভীর নলকুপের ম্যানেজার সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মাটি কাটার কারণে পাইপগুলো ফেটে গেছে। এতে পাম্প চালানোও সম্ভব হচ্ছে না। দুই বছর ধরে পাম্প বন্ধ। পাম্প না চালানোর কারণে কৃষকরা বোরো-ইরি চাষের জন্য পানি পাচ্ছেন না। ফলে অনেক জমি অনাবাদী থেকে যাবে। এতে কৃষক পরিবারের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দেবে।’

এদিকে, মাটি কাটার কারণে গ্রামীণ সড়কগুলো ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। খবর পেয়ে উত্তর কাশিমপুরে ছুটে যান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-এর সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্রসেচ-ফেনী) মো. কামরুল হাসান। তিনি মাটি কাটার মেশিন ও একটি পিকআপ জব্দ করেন। পরে এই বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরীন সুলতানাকে জানান। তবে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপস্থিত হতে দেরি হওয়ায় গাড়িগুলো মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেন। 

কামরুল হাসান বলেন, ‘এই পর্যন্ত চার বার এই এলাকায় এসে মাটি ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছি। তারা কর্ণপাত করছেন না। তাদের আইনের মাধ্যমে শাস্তি দিলে মাটি কাটা বন্ধ হবে। এতে রক্ষা পাবে কৃষি জমি।’

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মানিক বলেন, ‘এখানে পাঁচটি ইটভাটা রয়েছে। মাটি কাটার কারণে সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিজমিও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বারবার বাধা দেওয়ার পরও তারা মানছেন না। উল্টো তাদের শত্রু হয়ে যাচ্ছি। প্রশাসন যদি ব্যবস্থা না নেয়, আমাদের কিছু করার নেই। ’

জানতে চাইলে ফেনী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিধ মো. তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মাটি কাটার বিষয়ে দ্রুত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। ’

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরীন সুলতানা বলেন, ‘রাতে মোবাইল কোর্ট চালানোর নিয়ম নেই। মাটি কাটা ঠেকাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।  না হলে কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যাবে। ’

উল্লেখ‌্য, ফেনী জেলায় ১০৮টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে ৬টির পরিবেশের ছাড়পত্র রয়েছে। বাকি ১০২টির কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।  
 

ফেনী/এনই

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়