রেডএলার্টেও বেপরোয়া সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হরিণ শিকারিরা। বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে ও গুলি করে হরিণ শিকার করছে তারা।
গত ২০ দিনের ব্যবধানে সুন্দরবন থেকে শিকার করা ১৯টি হরিণের চামড়া, ৮৫ কেজি মাংসসহ ১১ জন চোরা শিকারিকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে, হরিণ শিকারীদের রুখতে ২৩ জানুয়ারি থেকে সুন্দরবনজুড়ে রেডএলার্ট জারি করা হয়েছে। এছাড়া শরণখোলা রেঞ্জে সকল প্রকার পাশ পারমিট প্রদানও সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। তারপরও থেমে নেই হরিণ শিকার।
সর্বশেষ ৭ ফেব্রুয়ারি মোংলা উপজেলার দক্ষিণ দিগরাজ বালুরমাঠে অভিযান চালিয়ে ২২ কেজি হরিণের মাংসসহ কামাল শিকদার (৩৯) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে মোংলা থানা পুলিশ। আটক কামাল শিকদার দক্ষিণ দিগরাজ এলাকার জামাল শিকদারের ছেলে। তিনি স্থানীয় একটি কারখানায় চাকরি করেন।
মোংলা থানার এসআই ইমলাক সরদার বলেন, ‘হরিণের মাংস বিক্রির জন্য এক ব্যক্তি অপেক্ষা করছে- এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে নিজ বাড়ির সামনে থেকে কামালকে আটক করা হয়। এসময় কামালের কাছে থাকা ২২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়।’
সুন্দরবন বিভাগ, কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে কেওড়া গাছের আধিক্য থাকা স্থানগুলোতে হরিণের বিচরণ বেশি। সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহীনে সেসব স্থানে অবস্থান নিয়ে নৌকা, ট্রলার ও গাছে মাচা পেতে হরিণের গতিবিধি লক্ষ্য করে।
হরিণ নদী ও খালের চরাঞ্চলে ঘাস খেতে আসে। শিকারিরা এসব স্থানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। কখনও তারা গুলি ছুড়েও শিকার করে। পরে গোপন আস্তানায় মাংস তৈরি করে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে।
সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, শরণখেলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ বনের আশপাশ এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এভাবে হরিণ শিকার করে বিক্রি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়েন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
এই সূত্র জানায়, ৩০ জানুয়ারি গভীর রাতে মোংলা উপজেলার দিগরাজ বাজার সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি হরিণের মাথা ও ৪৭ কেজি মাংসসহ তিন চোরাকারবারিকে আটক করে কোস্ট গার্ড সদস্যরা। এসময় তিনটি মোবাইল ফোন, একটি হরিণের মাথা ও ভুড়িসহ ৪৭ কেজি মাংস জব্দ করে কোস্টগার্ড।
এর আগে ২২ জানুয়ারি রাত পৌনে দুইটার দিকে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা সদরের ব্র্যাক অফিসের সামনে থেকে শিকার করে আনা হরিণের ১৯টি চামড়াসহ দুই পাচারকারীকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
২৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১টার দিকে খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্থানীয় মাসুদের দোকানের সামনে রাস্তার ওপর সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা হরিণের ১১ কেজি মাংসসহ দুইজনকে আটক করে থানা পুলিশ।
একইভাবে ২৪ জানুয়ারি উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের ধোপাদী গেটের পাশে অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে সাড়ে চার কেজি হরিণের মাংসসহ তিন পাচারকারীকে আটক করে পুলিশ।
অভিযোগ রয়েছে, বনদস্যুরা এখন তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়। তবে হরিণ শিকারিদের চক্রগুলোর উৎপাত সুন্দরবনে বেড়েছে বেপরোয়াভাবে। শিকারিদের ধরতে সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রল এবং বন বিভাগের টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিকার কমছে না।
বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে আবার কখনো এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। পরে বিভিন্ন কৌশলে এ হরিণের মাংস খুলনা-বাগেরহাট এমনকি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে নানা দামে। তবে বেশি দামে বিক্রি হয় চামড়া।
এভাবে বিক্রি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে পথে ঘাটে ধরা পরে দুই এক জন শিকারি। ধরা পড়া দুই একজন ব্যক্তিকে ছেড়ে দিয়ে অর্থ বাণিজ্য করে কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও পুলিশ।
ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধি এ সব শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় দিন দিন সুন্দরবনে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে।
অনেকে বলছেন, আগে এক সময় সুন্দরবনে অহরহ হরিণ শিকার চলত। বন বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় মাঝে হরিণ শিকার অনেক কম ছিল। কিন্তু সম্প্রতি হরিণ শিকার বেড়েছে।
এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার লোকজন জেলে সেজে পাশ পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে এসব অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। চোরা শিকারীরা অনেক শক্তিশালী। এদের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এদের ধরতে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকজন খুব একটা সহযোগীতা করে না। এদের বিরুদ্ধে মানুষ স্বাক্ষী দিতেও ভয় পায়।
যেহেতু স্বাক্ষী পাওয়া যায় না, স্বাক্ষী দুর্বল থাকে। এর ফলে এই চোরা শিকারীরা সেই সুযোগটা নেয়। তারা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বারবার এই ধরনের অপরাধ করার সাহস করে। এদের যদি কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা যায়, তাহলে সুন্দরবনে শিকারীদের তৎপরতা রোধ করা আরও সহজ হবে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, বন অধিদপ্তরের নির্দেশে ২৩ জানুয়ারি থেকে সুন্দরবনজুড়ে রেডএলার্ট কার্যকর করতে বন বিভাগের সকল স্টেশন, ক্যাম্প ও ফাঁড়িগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া হরিণ শিকারীদের রুখতে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে সকল প্রকার পাশ পারমিট প্রদানও সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে থাকা শিকারীদের একটি তালিকা তৈরি করেছি। তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের নজরদারীর মধ্যে রাখা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে সার্বক্ষণিক সুন্দরবন পাহারায় আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিং আরও বাড়ানো হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগ তৎপর রয়েছেন।’
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোটরসাইকেল বা গাড়ি নিয়ে বনের মধ্যে যেতে পারে না। বিস্তীর্ণ বনের প্রত্যেকটি খালের আলাদা আলাদা বনরক্ষী দিতে পারলে হয়তো হরিণ শিকার কমে যেত।’
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বন্যপ্রাণি শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে হরিণ শিকার করছে একটি চক্র। এতে সুন্দরবনে দিন দিন কমে যাচ্ছে হরিণের সংখ্যা। সম্প্রতি হরিণ শিকার বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে বনদস্যু আটক হয়ে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হচ্ছে। সেখানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে। এর পেছনে বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।’
উপ বন সংরক্ষক মো. কবির হোসেন পাটোয়ারী বলেন, ‘হরিণ শিকারিদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তথ্য প্রমাণ পেলেই তাদের ধরা হচ্ছে- শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বন বিভাগ এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিকারি ধরা পড়লে মামলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দুই দিন পর আদালত থেকে তারা জামিন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে।’
খুলনা/সনি
আরো পড়ুন