ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রঙের প্রলেপে জেগে ওঠে শহীদ মিনার

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
রঙের প্রলেপে জেগে ওঠে শহীদ মিনার

ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের এক গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জে গুরুদয়াল সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের জনতা।

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২১ উপলক্ষে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণের শহীদ মিনারটি ধোয়া-মোছা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং রঙের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলছে শেষ মুহূর্তের আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি। তাই শেষ মুহূর্তে শহীদ মিনারে পাদদেশসহ পায়ে চলার রাস্তাও রং-তুলির আঁচড়ে সাজানো হয়েছে। আজ রাতের প্রথম প্রহরে বীর শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে অপেক্ষার প্রহর গুনছে কিশোরগঞ্জবাসী।

কিশোরগঞ্জ শহরে ১৯৬৩ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়। আবু তাহের খান পাঠানের নেতৃত্বে বের করা হয় প্রভাত ফেরি। প্রভাত ফেরিটি কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে নির্মিত একটি প্রতীকী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ‌্য অর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। সেখানে সমবেত হয়েছিল হাজার হাজার লোক। 

এরপর ১৯৬৬ সালে কিশোরগঞ্জ শহরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় গুরুদয়াল কলেজ মাঠে। গুরুদয়াল কলেজের ফান্ড থেকে ৭০০ টাকা ব্যয়ে সেটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই শহীদ মিনার নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তৎকালীন ছাত্র সংসদের ভিপি এবং বর্তমান মহামান‌্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

একাত্তর সালে পাকবাহিনী সেই শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ছাত্র সংসদের ভিপি নূরুল ইসলাম নূরুর নেতৃত্বে শহীদ মিনারটি পুনরায় নির্মিত করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই একুশের প্রথম প্রহর থেকে জনতার ঢল নামে। প্রতিবছরই জেলা প্রশাসন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সাধারণ মানুষ ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে এ শহীদ মিনারে আসেন।

তবে যে শহীদ মিনারকে ঘিরে এতে আয়োজন সেটির অবহেলা ও অযত্ন নিয়ে সাধারণ জনমনে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। গুরুদয়াল মাঠে শহীদ মিনার এলাকায় গিয়ে চোখে পড়ল পরিষ্কার-পরিচ্ছতায় নিয়োজিত কর্মীদের তোড়জোড়। চলছে ধোয়ামোছার কাজ। আর এ সকল কাজ বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত বিভাগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বলেন, ‘গত দুদিন ধরে তারা কাজ করছেন। প্রথমে বেদি থেকে ধূলার আস্তরণ ঘষে তুলে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়েছে। এখন রঙের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। সারা বছর রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ধূলা জমে গেছে। সেগুলো এখন তুলতে কষ্ট হচ্ছে। শেষ মুহূর্তের কাজ এখন করছি।’

স্থানীয় বাসিন্দা শামছুল মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই শহীদ মিনারটি পরিস্কারের তোড়জোড় বাড়ে। অথচ বছরের বাকি ৩৬৪ দিন অবহেলায় পড়ে থাকে। নিরাপত্তার বেষ্টনির চারপাশ নোংরা থাকে। অনেকেই কাপড়চোপড় নেড়ে রাখে। যেগুলো দৃষ্টিতে আঘাত করে। এছাড়া শহীদ মিনারের পবিত্রতাও নষ্ট হয়। তাই সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি, যাদের সম্মানে ও শ্রদ্ধায় শহীদ মিনারটি নির্মিত সারাবছর জুড়ে যেন সেটির পবিত্রতা রক্ষা করা হয়।’

বাংলা বিভাগের সম্মান পড়ুয়া শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘যে শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এ ভাষায় আমরা কথা বলতে পারছি, আমরা কিন্তু তাদের সঠিক মর্যাদা দিতে পারছি না। বছরের একদিন ছাড়া বাকি সময়টাতে এ শহীদ মিনারে কোনো নিরাপত্তা থাকে না। উন্মুক্ত থাকায় যত্রতত্র শহীদ মিনারটির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এমনকি লোহার তৈরি মূল ফটকের একাংশ চুরিও হয়ে গেছে। সারাবছর শহীদ মিনারটির অবহেলায় পড়ে থাকে।’

কবি ও সাহিত‌্যিক বাঁধন রায় রাইজিং বিডিকে বলেন, ‘এই শহীদ মিনার তো শুধু একটি দিবসকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়নি। সারা বছর অবহেলায় রেখে শুধু এক দিনের জন্য ধোয়ামোছা করলে শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষা হয় না। তাছাড়া বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে শহীদ মিনারটিকে আরও পরিপাটি করে রাখা এখন সময়ের দাবি।’

গুরুদয়াল সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর মো. ইমান আলী বলেন, ‘শহীদ বেদির পবিত্রতা রক্ষায় আমাদের চেতনা সৃষ্টি করতে হবে। এ শহীদ মিনারটি মহামান‌্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাত ধরেই প্রথম তৈরি হয়েছিল। প্রথমে এটি শুধুমাত্র কলেজকেন্দ্রিক হলেও এখন কিশোরগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রূপ নিয়েছে। তাই আমরা চাই শহীদ মিনারটিকে ঘিরেই একটি আধুনিক রূপরেখা তৈরি করা হোক।’ 

এদিকে স্থানীয়রা সারাবছর শহীদ মিনারটির পবিত্রতা রক্ষা ও বাংলা ভাষা সম্পর্কে জ্ঞানের আলো ছড়াতে শহীদ মিনারটির পাশে একটি লাইব্রেরি ও ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরতে একটি সংগ্রহশালা তৈরির দাবি জানান।

রুমন চক্রবর্তী/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়