ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পাউবোর জমি-খাল কিনেছেন ‘ভূমিদস‌্যুরা’, দায় কার?

ইমরান হোসেন, বরগুনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:৩১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
পাউবোর জমি-খাল কিনেছেন ‘ভূমিদস‌্যুরা’, দায় কার?

বরগুনার আমতলীতে বেড়িবাঁধের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধিগ্রহণ করা ৮১ একর ৪৬ শতাংশ একর জমির মালিকানা দাবি করছেন স্থানীয় কয়েকজন। একইসঙ্গে তারা সরকারি খাল কিনেছেন বলেও দাবি করেন। তাদের দাবি, এই জমি তারা কিনে মালিক হয়েছেন। এভাবে সরকারি জমি কেনাবেচার জন‌্য পাউবো দুষছে বরগুনার সাব রেজিস্ট্রি অফিসকে।  সাব রেজিস্ট্রি অফিস বলছে, ‘ভূমিদস‌্যুরা’ তাদের বোকা বানিয়ে জাল দলিলের মাধ‌্যমে খাল ও পাউবোর জমি কেনাবেচা করেছেন। আর উপজেলা প্রশাসন বলছে, শিগগিরই দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। 
 
পাউবো-সূত্র বলছে, আমতলী উপজেলা শহর রক্ষা বেড়িবাঁধের জন্য ১৯৬২-১৯৬৩, ১৯৬৩-১৯৬৪, ১৯৬৬-১৯৬৭ ও ১৯৬৭-১৯৬৮ অর্থবছরে  উপজেলার ঘাটখালীর ২৯ একর ও চাওড়ার ১৬ দশমিক ২৪ একর জমি কয়েক দফায় অধিগ্রহণ করে বোর্ড। সম্প্রতি  এসব জমিসহ মোট ৮১ একর ৪৬ শতাংশ জমিতে বালু ভরাট করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করছেন আমতলীর জহিরুল ইসলাম খোকন মৃধা ও রিয়াজ উদ্দিন মৃধা।  পাউবোর পক্ষ থেকে বালু ভরাটের কারণ জানতে চাইলে তারা এসব জমি কিনেছেন বলে দাবি করেন।  

বোর্ড সূত্রে জানা গেছে,  ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল প্রথম দলিলে চাওড়া মৌজার ২ একর ৮৩ শতাংশ জমি জহিরুল ইসলাম বাবুল (দলিল লেখক, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, আমতলী), পলাশ হাওলাদার (দলিল লেখক, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, আমতলী), বাবুল রাঢ়ী, আতাহার হাওলাদার ও মো. শাহজাহান আকনের কাছে বিক্রি করেন  যুগল চন্দ্র পাইক ও বিপুল চন্দ্র পাইক। 

খাল ভরাট করে প্লট বানিয়ে  চলছে বেচাকেনা

এরপর ২০১৮ সালের দ্বিতীয় দলিলে চাওড়া মৌজার ২ একর ৪৭ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি  জহিরুল ইসলাম খোকন মৃধা ও রিয়াজ উদ্দিন মৃধার কাছে বিক্রি করেন জহিরুল ইসলাম বাবুল (দলিল লেখক, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, আমতলী), পলাশ হাওলাদার (দলিল লেখক, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, আমতলী), বাবুল রাঢ়ী ও মো. শাহজাহান আকন।
  
২০১৮ সালের ৯ জুলাই তৃতীয় দলিলে ঘটখালী মৌজার ১১ একর ৭২ শতাংশ জমি  জহিরুল ইসলাম খোকন মৃধা ও রিয়াজ উদ্দিন মৃধার কাছে বিক্রি করেন যুগল চন্দ্র পাইক ও  বিপুল চন্দ্র পাইক। 

২০১৮ সালের ২৫ জুলাই ৪র্থ দলিলে ঘটখালী মৌজার ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ জমি জহিরুল ইসলাম খোকন মৃধা, রিয়াজ উদ্দিন মৃধা, জহিরুল ইসলাম বাবুল (দলিল লেখক, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, আমতলী), পলাশ হাওলাদার (দলিল লেখক, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, আমতলী), বাবুল রাঢ়ী মো. শাহজাহান আকনের কাছে বিক্রি করেন বিপুল চন্দ্র পাইক ও যুগল চন্দ্র পাইক। 

এই বিষয়ে বরগুনার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কাইছার আলম বলেন, ‘‘অধিগ্রহণ করা এসব জমির মধ্য থেকে ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল চাওড়া মৌজার ২ একর ৮৩ শতাংশ জমির ‘জাল দলিল’ করে গোপন রাখেন উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক জহিরুল ইসলাম বাবুল, পলাশ হাওলাদার। তাদের সহযোগিতা করেন বাবুল রাঢ়ী, আতাহার হাওলাদার ও শাহজাহান আকন।’’ 

নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘প্রথম ধাপে দলিল  জালিয়াতিতে সফল হয় চক্রটি।  এরপর আরও তিন ধাপে তারা এসব জমি কেনাবেচনা করেন।’ তিনি  আরও বলেন, ‘চাওড়া মৌজার সরকারি খালেরও জাল কাগজপত্র তৈরি করে নিজেদের মালিক দাবি করে বালু ভরাট শুরু করেন খোকন মৃধা ও রিয়াজ মৃধা।’

এই প্রসঙ্গে আমতলীর পৌর এলাকার বাসিন্দা ফোরকান দফাদার, কবির মিয়া, মাসুম, অনিমেষ দাস বলেন,  ‘অনেক আগে থেকেই এসব জমি পাউবোর। তবে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে এসব জমিতে বালু ভরাট করে শতাংশ প্রতি ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে বিক্রি করা শুরু করেন খোকন মৃধা ও রিয়াজ মৃধা।’

জানতে চাইলে এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি রিয়াজ মৃধা। আর খোকন মৃধা বলেন, ‘ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে জমির খাজনা পরিশোধ করেছেন বিপুল পাইক ও যুগল চন্দ্র পাইক। সেই কাগজ দেখেই আমরা জমি কিনেছি।’ 

তবে, এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি বিপুল পাইক ও যুগল চন্দ্র পাইক।

স্থানীয় ভূমি অফিস বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল  পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ১৮ বার পাউবোর অধিগ্রহণ করা জমির খাজনা পরিশোধ করেছেন দখলদাকারীরা। সরকারি বিধি মেনে একই জমির খাজনা পরিশোধ করেছে বোর্ডও।

বালু ফেলে খাল ভরাট চলছে

কিভাবে পাউবোর জমির খাজনা দখলদাররা পরিশোধ করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আমতলী সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, ‘খোকন মৃধা ও রিয়াজ মৃধার  পেশীশক্তির কাছে আমি অসহায়। তাই তাদের কথায় যুগল পাইক ও বিপুল পাইকের নামে খাজনা নিয়েছি।  একই জমির খাজনা পাউবোও পরিশোধ করেছে।’ 

এদিকে, দলিল লেখক জহিরুল ইসলাম বাবুল ও পলাশ হাওলাদার সরকারি খালের জমির জাল কাগজের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলেন,  ‘ভুল হয়ে গেছে।’ 

ভূমিদস‌্যুদের জাল-জালিয়াতির কৌশলের কাছে আমতলী সাব রেজিস্ট্রি অফিস পরাজিত দাবি করেন তৎকালীন কর্মকর্তা মো. মাসুম। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘চক্রটির জালিয়াতি ধরতে পারেননি আমার আগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।’

এ বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের রেজিস্ট্রার মো. সিরাজুল করিম বলেন, ‘এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। দ্রুত তদন্ত করে এসব জাল দলিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’ 

সরকারি খালের জমি দখল করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান।

দ্রুত এসব জমি উদ্ধারে কাজ শুরুর কথা জানালেন পাউবোর  নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কাইছার আলম। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে দখলদারদের জমি ছাড়ার জন্য নোটিশ দিয়েছি।’ এসব জাল দলিলের বিরুদ্ধে শিগগিরই আদালতে মামলা করবেন বলেও তিনি জানান। 

বরগুনা/এনই 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়