ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হঠাৎ কেন অশান্ত কোম্পানীগঞ্জ

মাওলা সুজন, নোয়াখালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
হঠাৎ কেন অশান্ত কোম্পানীগঞ্জ

নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী আবদুল কাদের মির্জার বিভিন্ন বক্তব‌্যে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ‌্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি নবনির্বাচিত পৌরমেয়র কাদের মির্জা ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের মধ‌্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান স্থানীয় এক সাংবাদিক। এছাড়া, গুলিবিদ্ধসহ আহত হন আরও অন্তত ৩৫জন। এসব ঘটনায় অশান্ত হয়ে ওঠে পুরো কোম্পানীগঞ্জ। 
 
এর আগে ২০১৩ সালে ছাত্র শিবির ও পুলিশের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল কোম্পানীগঞ্জ। ওই সময় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৮ জন। ওই ঘটনার প্রায় আট বছর পর এই অঞ্চল আবারও অশান্ত হয়ে উঠলো। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে আবদুল কাদের মির্জার ‘সত্য বচন’কে কেন্দ্র করে শুরু হয় অস্বস্তি। ধীরে ধীরে তা রূপ নিয়েছে সহিংসতায়। 

সম্প্রতি ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য সারাদেশে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় ওঠে। এসব বক্তব্যে তিনি দল, বিভিন্ন নির্বাচন, দলীয় কয়েকজন এমপি, কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা এবং তার বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেন। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের অভিযোগ—কাদের মির্জা স্থানীয় রাজনীতিতে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য খেয়াল-খুশিমতো কমিটি ভাঙছেন, আবার কমিটি গড়ছেন। প্রতিপক্ষরা তার একক আধিপত‌্যের বিরোধিতা করে রাজনৈতিকভাবে মাঠে নামায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রাজনীতি অশান্ত হয়ে উঠেছে। 

কয়েক দিন ধরে কোম্পানীগঞ্জে কাদের মির্জার একক সভা-সমাবেশ হলেও শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম‌্যান মিজানুর রহমান বাদল মাঠে নামেন। এরপরই কাদের মির্জা ও বাদলের অনুসারীদের মধ্যে শুরু হয় গোলাগুলি। এই ঘটনায় সাত জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন ৩৫ জন। এছাড়া, স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক‌্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দু’পক্ষের লোকদের হাতেই দেখা গেছে আগ্নেয়াস্ত্র। কয়েকদিনে কোম্পানীগঞ্জে বেড়েছে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহ। এলাকার বাইরে থেকে বন্দুকধারী কিছু সন্ত্রাসীও এই উপজেলায় ঢুকে পড়েছে। তারা আরও জানান, কোম্পানীগঞ্জে কারও কাছে লাইসেন্স করা অস্ত্র নেই। মাঠ দখল করতে পেশাদার সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছে স্বার্থান্বেষী মহল। সন্ত্রাসীদের হাতে দেশীয় এলজি, চায়না পিস্তল দেখা গেছে।  
শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) কাদের মির্জা ও বাদলের সংবাদ সম্মেলন চলার সময় কয়েকজন অস্ত্রধারীকে দেখা গেছে। সবার মাথায় ছিল হেলমেট। সারা শরীর চাদরে ঢাকা। চাদরের ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে অস্ত্র বেরিয়ে পড়তে দেখা গেছে বলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একপক্ষের অভিযোগ, কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় নিজের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছেন। তিনি দলের গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা করছেন না। কেউ তার মতের বিরুদ্ধে গেলেই তাকে দল থেকে বাদ দিচ্ছেন। পরন্তু চলমান নির্বাচন, দলীয় এমপি, কেন্দ্রীয় নেতা ও ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে আপত্তিজনক মন্তব‌্য করেছেন। যা রাজনৈতিক শালীনতার ভেতরে পড়ে না বলেও তাদের অভিযোগ। 

আর কাদের মির্জার পক্ষের দাবি, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীরা এলাকায় প্রচুর অস্ত্র এনেছেন। সেই অস্ত্র ব্যবহার করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন। তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টাও করেছিলেন। স্থানীয় রাজনীতিতে যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের দল থেকে সরিয়ে দিয়েছেন কাদের মির্জা। তিনি চান, সুস্থ ও সুন্দর রাজনীতির ধারা তৈরি করতে। এক্ষেত্রে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ান, তিনি তাদের ছেঁটে ফেলতে বলেছেন, বর্জন করতে বলেছেন। আর তাতেই অপরাজনীতিতে জড়িতরা ক্ষেপে উঠেছেন। 
এদিকে, কাদের মির্জা বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন বলে অভিযোগ এনেছেন জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। নিয়ে জেলা দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তারা বলেন, ‘কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন, যা দলের গঠনতন্ত্র -পরিপন্থী। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড, জেলা আওয়ামী লীগ ও তৃণমূল-পর্যায়ের নেতাদের মত উপেক্ষা করে কাদের মির্জা নিজেই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন। তিনি থানা ঘেরাও করেছেন। সড়ক অবরোধ করেছেন। হরতাল করেছেন। তিনি কেন এসব করছেন?’ এসময় তারা কাদের মির্জার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব‌্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান। 

বসুরহাটের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ‘উপজেলায় এই মুহূর্তে অন্য কোনো দলের কর্মসূচি নেই। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, অথচ সেই দলের নেতারা অস্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। আমরা ব্যবসায়ীরা মহাবিপদে আছি। আশা করেছিলাম, ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকবে। কিন্তু এখন দেখছি উল্টো। সবাই পদের জন্য উদগ্রীব। যেভাবে হোক নিজের মাঠ দখলে রাখার জন্য যা যা করার দরকার, তা করছেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উচিত, শিগগিরই এই সমস‌্যার সমাধান করা। ’

অস্ত্রধারীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে কোম্পনীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল বলেন, ‘এদের চিনি না। সারাজীবন অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জে একক আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছেন। তিনি চান না, আর কেউ রাজনীতি করুক। তিনি এখন মাঠ দখল করতে অস্ত্রবাজদের ব্যবহার করছেন। আমি তার অপরাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছি।’
এ বিষয়ে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার মোবাইলফোনে কল দিলি তিনি তা কেটে দেন।

অভিযোগের বিষয়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কাদের মির্জা যেসব কথা বলছেন, তা মিথ্যা-বানোয়াট। আমরা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে কোম্পানীগঞ্জের সাম্প্রতিক সহিংসতার বিষয়ে জানিয়েছি। আশা করি, কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে।’

কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের কোন্দল ও গোলাগুলি প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। জনগণ এটা আশা করেনি। এই অস্থির অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। আশা করি, এ বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। ’

জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘কোম্পানীগঞ্জে কোনো অস্ত্রবাজের রক্ষা নেই। যে দলেরই হোক, যে হোক আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে রয়েছি। আশা করি, তাদেরি গ্রেপ্তারে সক্ষম হবো। ’ পুলিশের কাছে অস্ত্রের যে তথ্য আছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান। 

নোয়াখালী/এনই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়