লালদিয়ার চর ছাড়ছেন বাসিন্দারা

মোহাম্মদ আমিন। ২৮ বছরের যুবক। লালদিয়ার চরে তার জন্ম। শৈশব থেকে কৈশোর, তারুণ্য সবকিছুই তার এই চর ঘিরে। সেই স্মৃতিবিজড়িত ভিটেবাড়ির সব নিজের হাতে ভেঙে নিয়ে ছাড়তে হচ্ছে এলাকা। নিজের ঘর ভাঙছেন, আর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।

হাসিনা বেগম। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। ভাঙাবাড়ির জিনিসপত্র বস্তাভর্তি করতে করতে আহাজারি করছিলেন- কোথায় যাবেন, কোথায় আশ্রয় পাবেন। ৫০ বছরের ভিটেবাড়ি ভেঙে নিয়ে তাকেও চলে যেতে হচ্ছে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে।  

হাসিনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে রাইজিংবিডিকে জানালেন, ৮০ বছর বয়সী শাশুড়ি, স্বামী ও সন্তান নিয়ে তার আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা নেই। রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবু তাকে বসতভিটা ছেড়ে যেতে হচ্ছে।  

এটা চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন লালদিয়ার চরের দৃশ্য। প্রায় আড়াই হাজার পরিবারের ১৪ হাজার বাসিন্দার বাস এখানে। আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে বন্দর ও কর্ণফুলী নদীর জায়গা উদ্ধার করতে এক সপ্তাহ আগে থেকে উচ্ছেদের প্রস্তুতি নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বসবাসকারীদের নোটিশ দেওয়া হয়। মাইকিং করে জায়গা ছাড়ার আহ্বান জানানো হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে উচ্ছেদ অভিযানের আগে একে একে লালদিয়ার চর এলাকা ছাড়তে শুরু করে বাসিন্দারা। 

সোমবার (১ মার্চ) ছিল উচ্ছেদ অভিযানের নির্ধারিত দিন। ১০টিরও বেশি এসকেবেটর, বুলডোজার, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক হাজারেরও বেশি সদস্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু এই রণসজ্জার কিছু ব্যবহার করতে হয়নি বন্দর কর্তৃপক্ষের। বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে নিজেরাই এলাকা ছাড়ছেন। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান জানান, আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযানের পূর্বে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে বসবাসকারীদের স্বেচ্ছায় চলে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এর ফলে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ নিজেরা সরে গেছে। অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন হয়নি। 

উচ্ছেদ অভিযানের প্রস্তুতির মুখে নিজের ভিটেবাড়ির সরঞ্জাম ট্রাকে তুলে এলাকা ত্যাগ করতে করতে সাইফুল নবী রাইজিংবিডিকে বলেন, ৪০ বছর পূর্বে বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটির জন্য তাদের বাপদাদার বসতভিটা সরকারকে ছেড়ে দিতে হয়। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে লালদিয়ার চরে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু এখন লালদিয়ার চর থেকেও তাদের উচ্ছেদ করে দেওয়া হলো।

অসংখ্যা নারী-পুরুষের আহাজারিতে লালদিয়ার চরের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। চারিদিকে অশ্রুসিক্ত মানুষ। এক অন্যরকম ধ্বংসস্তুপ। 

প্রায় আড়াই হাজার পরিবারকে উচ্ছেদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫২ একর ভুমি নিজেদের আয়ত্তে নিচ্ছে। বাসিন্দারা এলাকা ত্যাগ করার পর পুরো এলাকা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হবে।