ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

৩ চাকাতেই আটকে গেল শান্ত’র স্বপ্ন

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ৩ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১২:৩২, ৩ এপ্রিল ২০২১
৩ চাকাতেই আটকে গেল শান্ত’র স্বপ্ন

করোনা পরিস্থিতিতে গত একবছর ধরে বন্ধ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমন অবস্থায় যেমন চিন্তিত অভিভাবক,তেমনি পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে শিশু ও নাবালক শিক্ষার্থীদের যতই দিন গড়াচ্ছে ততই তারা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।

এমন অবস্থায় ব্যস্ততম সড়কে হঠাৎ চোখে পড়ে তিনচাকার বাহন মিশুকের ড্রাইভিং সিটে বসা এক নাবালক ছেলে। হাত উঁচিয়ে ডাক দিতেই সে গাড়িটি নিয়ে এসে পাশে থামায়। তারপর গাড়িতে উঠে যেতে যেতে জানা গেলো তার জীবনের গল্প।

ফাহিম হোসেন শান্ত। বয়স মাত্র ১২ বছর। বাবা, মা, ৬ ভাই ও এক বোন নিয়ে তাদের পরিবার। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আর সন্তানের পড়াশোনা করাতে গ্রাম থেকে কিশোরগঞ্জ শহরের শোলাকিয়া গাছবাজার গেঞ্জিমিলের পাশে বাসাভাড়া নেন শান্ত’র বাবা বাবুল মিয়া। বাবা ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে কোনো রকম চালাচ্ছিল তাদের জীবন। 

কিন্তু পরিবারের সদস্য বেশি হওয়ায় অভাব যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। তাই তার বাবার সঙ্গে একই কাজে যোগ দেন তার বড় ভাই। বেশ কিছুদিন ভালই চলছিল। শান্ত তখন স্থানীয় একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো। কিন্তু এরই মধ্যে সারাদেশে করোনা এলো। বন্ধ হয়ে গেল স্কুল, বন্ধ হলো শান্ত’র পড়াশোনা। এদিকে, লকডাউন থাকায় আবারও শুরু হয় পরিবারে আর্থিক সংকট।

পরিস্থিতি সামলে নিতে শান্ত নাবালক বয়সে বাবার কাছে অটোরিকশা চালানো শিখতে বাধ্য হয়। নিজের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নকে আড়াল করে, এই বয়সেই ধরে পরিবারের হাল। প্রতিদিনের রোজগারের টাকা তুলে দেন বাবার হাতে।

শান্ত রাইজিংবিডিকে জানায়,সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে মিশুক রিকশা চালাতে হয়। মালিককে ৩২০ টাকা দিয়ে বাকি যা থাকে সেটি বাবার হাতে বুঝিয়ে দেয়। পড়াশোনা শিখে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এখন বোধহয় সেটা আর সম্ভব না। স্কুল বন্ধ-পড়াশোনা বন্ধ-অন্যদিকে অভাবের সংসার। স্কুল খুলে দিলেও হয়তো আর স্কুলে যাওয়া হবে না। কারণ সংসারের হাল ধরতে বাবার পাশে থাকতে হবে। আর যদি ভাগ্যে পড়াশোনা থাকে তাহলে হয়তো আবার স্কুলে যাওয়া সম্ভব হবে তার।

শান্ত’র বাবা বাবুল মিয়া রাইজিং বিডিকে বলেন, ‘শান্ত পড়াশোনাতে বেশ ভাল ছিল। কিন্তু বড় পরিবার নিয়ে অভাব আর করোনার সময়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন শান্ত জোড় করে আমার কাছ থেকে গাড়ি চালানোটা শিখে। একজন ড্রাইভারের সন্তান ড্রাইভার হবে এটা আমি কখনও চাইনি। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু অভাব সেটা হতে দিল না। তাই আমিও বাধ্য হই ওকে গাড়ি চালানো শিখাতে। প্রথমে ছোট বলে গাড়ির মালিকরা তাকে গাড়ি দিতে চায়নি। পরে অবশ্য একটি মিশুক রিকশা তাকে ব্যবস্থা করে দেই। তবে ছেলেটার জন্য অনেক চিন্তা হয়, বয়স কম ছোট। তাছাড়া দিনকালও ভাল না। কিন্তু অভাবের তাড়নায় আবার কিছু বলতেও পারি না।’

কিশোরগঞ্জ পৌর মহিলা কলেজের অধ‌্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী জানান, নিম্ন আয়ের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষজন তাদের সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে আর ভাবছেন না। তারা মনে করেন, আগে বাঁচতে হবে, তাই পরিবারের নাবালক ও সাবালক সকলকেই একসঙ্গে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। কিন্তু এতে করে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। তাই এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিদের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিকে এমন অস্বচ্ছল মানুষদের পাশে থাকার আহবান জানান তিনি।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল কাদির মিয়া রাইজিংবিডিকে জানান, আসলে এমন কোনো বিষয় এখনও আমার কাছে আসেনি বা আমিও অবগত ছিলাম না। তাছাড়া, আইনগতভাবে ১৮ বছরের নিচে নাবালকদের গণপরিবহন চালানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ তার সঙ্গে সর্বসাধারণের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। তবে শহরে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলা রক্ষা করতে জেলা প্রশাসন থেকে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর করোনা পরিস্থিতিতে যদি এমন কোনো ধরণের বিষয় আমাদের কাছে সুপারিশ আকারে আসে,তাহলে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করব।

কিশোরগঞ্জ/বুলাকী

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়