ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যেখানে পথে পথে দালাল, পদে পদে ঘুষ 

মাওলা সুজন, নোয়াখালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৬, ১৪ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৭:৪১, ১৪ এপ্রিল ২০২১
যেখানে পথে পথে দালাল, পদে পদে ঘুষ 

নোয়াখালীতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কার্যালয়ে দালাল ও ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিআরটিএ কার্যালয় থেকে সময়মতো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, টেক্স টোকেন, আয়কর, ডিজিটাল নম্বর প্লেট পেতে প্রায় হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের অভিযোগ,  ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার পরও দিনের পর দিন ফাইল আটকে রেখে অফিস খরচের নামে অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হচ্ছে। আর এই কাজে সক্রিয় রয়েছে দালালচক্র।  এখানে পথে পথে রয়েছে দালাল, পদে পদে দিতে হয় ঘুষ।  
 
নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচ তলায় রয়েছে বিআরটিএ’র কার্যালয়। ওই কার্যালয় থেকে সেবাপ্রার্থীরা বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন, রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ, টেক্স টোকেন, আয়কর সনদ, ডিজিটাল নম্বর প্লেট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেন। 

কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশার সব কাগজপত্র বাবদ ব্যাংকে জমা দিতে হয় ১৪ হাজার ২০০টাকা, মোটরসাইকেলের (১০০ সিসি-১৬০সিসি)  জন্য ১০ হাজার ১৫২ টাকা, ট্রাকের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৭ হাজার ৭৬৬ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৬ হাজার ৯৯৩ টাকা।  ১৫০০ সিসি কারের জন‌্য ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা, ২০০০ সিসির মাইক্রোবাসের জন‌্য ১ লাখ ২১ হাজার টাকা; বাস সর্বনিম্ন ৮৭ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫ হাজার টাকা  ফিস ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এরপর ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার রশিদসহ পুরো ফাইল অফিসে জমা দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী সেবাপ্রার্থীর কাজ এখানে শেষ হওয়ার কথা। এরপরই তার সেবা পাওয়ার কথা।  

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সরকারি ফি জমা দেওয়ার পরই হয়রানি শুরু হয়। এই টেবিল থেকে ওই টেবিল, আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করতে করতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েন।  এই সুযোগে অফিসের ভেতরে বিচরণ করা দালাল চক্র গ্রাহকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। এরপরই তারা  ঘুষ দেওয়ার পরামর্শ দেয়। এরপরা দালালরা  অফিস থেকে গ্রাহকের কাগজপত্র ফটোকপি করে ফাইল আকারে সাজিয়ে করে তাদের সামনে নিজেকে অফিসের লোক হিসেবে উপস্থাপন করে। এরপর  গ্রাহককে সঠিক কাগজপত্র পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মৌখিক চুক্তি করে। একইসঙ্গে কত দিনের ভেতরে কাগজপত্র তৈরি করে দেবে, তারও দিনক্ষণ জানিয়ে দেয় তারা। 

সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক নুর করিম এসেছেন নিবন্ধনের জন্য। তিনি সরকারি ফিস ব্যাংকে জমা দিয়ে বিআরটিএ কার্যালয়ে গত এক মাসে কয়েকবার এসেছেন কাগজপত্র জমা দিতে। কিন্তু কেউ তার কাগজপত্র জমা রাখেননি। তিনি বলেন, ‘সরকার-নির্ধারিত টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েও ঘুরছি। কিন্তু নিবন্ধন করার কাগজ জমা নিচ্ছে না।’

চাটখিল থেকে এসেছেন মিজানুর রহমান নামের একজন সেবাপ্রার্থী। তিনি বলেন, ‘আমার গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ করার জন্য বিআরটিএ কার্যালয়ের একজন টাকা নিয়েছেন। তিনি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা নিয়েছেন।’

কোম্পানীগঞ্জ থেকে আবু সায়ীদ নামে একজন এসেছেন  নতুন মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশনের জন্য। তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত ফিস জমা দেওয়ার পর বিআরটিএ অফিসে যাই। কিন্তু কর্মরতরা ব্যস্ততার অজুহাতে কাগজপত্র দেখেননি।  পরে টিটু নামে একজন এসে সব কিছু শুনে কাগজপত্র নিয়ে সময় নির্ধারণ করে দেন । তবে, এর জন্য দিতে হয়েছে অতিরিক্ত টাকা। এই টিটু দালালচক্রের সদস‌্য।’ 
 
সেনবাগ থেকে এসেছেন একজন বাস মালিক। তিনি গাড়ির ফিটনেস সনদ নবায়ন করার জন্য টাকা জমা দিয়ে অফিসে যান।  তখন তাকে গাড়ি আনতে বলেন একজন।  তিনি বললেন, ‘গাড়ি তো জেলাতে নেই।’ জবাবে তাকে দালালচক্রের সদস‌্য বলেন, ‘তাহলে পরে আসেন।’ কিছুক্ষণ পর একজন এসে সব শুনে কাগজ নিয়ে বলেন, ‘গাড়ি আনা লাগবে না। আপনার কাজ হয়ে যাবে। তবে, এ জন্য দিতে হয়েছে বাড়তি টাকা।’      

মো. জসিম নামে একজন সেবাপ্রার্থী বলেন, ‘নোয়াখালী বিআরটিএ কার্যালয় এখন অনিয়ম, দুর্নীতি আর দালালদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির কাগজপত্র ও ফিটনেস পরীক্ষাসহ প্রায় সব কাজই করতে এসে হয়রানির পাশাপাশি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অভিযোগ উঠেছে, এই অফিসে দালাল ছাড়া কোনো কাজ হয় না।’
 
সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে দালালদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আর দালালরা অফিস খরচের নাম করে ফাইল প্রতি অতিরিক্ত পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতিটি যানবাহনের ফিটনেসের জন্য অতিরিক্ত পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। যদি যানবাহনের কাগজপত্র ঠিক না থাকে, তাহলে চুক্তির মাধ্যমে কাগজ তৈরি করে ফিটনেস দেওয়া হয়।’


 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকার একটা অংশ প্রতিমাসে ভাগবাটোয়ারা হয় অফিসের কতিপয় অসাধুর মাঝে। ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের লিখিত এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় শতভাগ পাসের গ্যারান্টি দিয়েই টাকা হাতিয়ে নেয় দালাল চক্রের সদস্যরা। আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে মাসের পর মাস ঘুরেও সমস্যার সমাধান হয় না।’
  
এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় নোয়াখালী সদর উপজেলা থেকে আসা  সেবাপ্রার্থী আবুল কালাম বলেন, ‘মোটরসাইকেল ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য  এক দালালকে অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু প্রায় তিনি মাস কেটে গেলেও লাইসেন্স পাইনি। এখন সেই দালাল বলছে, আরও দুই হাজার টাকা দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অফিসে গেলে বোঝা যায় না, কে দালাল বা আর কে অফিসের লোক।’

সুবর্ণচর উপজেলা থেকে আসা সেবাপ্রার্থী রুবেল বলেন, ‘মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে দালালের সহায়তা না নেওয়ায় একাধিকবার হয়রানির শিকার হয়েছি। প্রাথমিক কাজ ও যাচাই-বাছাই শেষে অ‌্যাসেসমেন্ট স্লিপ নিয়ে ফি দেওয়ার পর মোটরসাইকেলটি পরিদর্শনের জন্য বিআরটিএ অফিসে হাজির করলে সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ স্টাফ জানান, চেচিস নম্বর ও ইঞ্জিন নম্বর ভুল হয়েছে। এই ভুল সংশোধন করতে আবারও অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। এরপর সব কাজ শেষে তারা আবার জানান, মোটরসাইকেলের নাম ভুল হয়েছে। আবারও জমা না দিলে এই ভুল সংশোধন করা যাবে না। অথচ আমি নিজে গাড়ির চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বর এবং মোটরসাইকেলের নাম আবেদনে সঠিকভাবে লিখে দিয়েছি। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা কিংবা দালালের শরণাপন্ন না হওয়ায় তারা বারবার ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে হয়রানি করেন।’ 

কবিরহাট উপজেলা এলাকা থেকে এসেছেন এস এম ফারুক। তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেলের মালিকানা বদলি করতে হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার পর অতিরিক্ত তিন-চার হাজার টাকা না দিলে বিভিন্ন অজুহাতে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়।’
 
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিআরটিএ কার্যালয়ের সহকারী-পরিচালক মো. ফারহানুল ইসলাম বলেন, ‘অফিসে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব রয়েছে। কাজের চাপও বেশি। সে কারণে দীর্ঘদিন থেকে অতিরিক্ত কয়েকজন লোক আমাদের সহায়তা করে আসছেন। তবে কোনো দালাল এই অফিসে নেই।’

অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রসঙ্গে ফারহানুল ইসলাম বলেন, ‘এখন সব কিছু জমা দিতে হয় ব্যাংকে । এখানে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। গ্রাহকরা টাকা জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য আবেদন করলেই সেবা পেয়ে যাবেন।’ তিনি বলেন, ‘নোয়াখালী সার্কেলের স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় বায়োমেট্রিক তথ্য ও ছবি গ্রহণের কাজটি কম্পিউটারে পুরোপুরি সম্পন্ন করতে কিছুটা তো সময় লাগবেই।’ 

/এনই/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়