ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মৃত সংস্কৃতিকর্মীর নামে সহায়তার অর্থ তুলে আত্মসাৎ 

মাগুরা প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ২৬ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৭:০৩, ২৬ এপ্রিল ২০২১
মৃত সংস্কৃতিকর্মীর নামে সহায়তার অর্থ তুলে আত্মসাৎ 

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের বাজার রাধানগর গ্রামে বাস করতেন বিধবা বৃদ্ধা সুধারানী চক্রবর্তী। দরিদ্র এই নারী ছিলেন স্বভাবকবি। শখেরবশে কবিতা লিখতেন। একমাত্র ছেলে ছাড়া তার কেউ ছিলো না। অন্যের বাড়িতে বাস করতেন। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভোগার পর তিনি গত বছর ১২ মার্চ মারা যান। ছেলে ভারতে পাড়ি জমান।

করোনায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সহায়তা পাওয়া কর্মহীন ও অসচ্ছল শিল্পী, কলাকুশলী এবং সংস্কৃতিকর্মীদের তালিকায় ৩৫৫ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তার নাম। সহায়তার ১০ হাজার টাকা কে বা কারা দুই কিস্তিতে তুলে নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন বলেন, তালিকায় থাকা সবাই সহায়তার টাকা তুলে নিয়েছেন। সুধারানীর টাকা কে তুলেছেন, তিনি তা জানেন না।

শুধু সুধারানীর টাকা নয়, মাগুরা শহরে একাধিক ফ্ল্যাট, দুটি বাড়ির মালিক এক কাস্টমস কর্মকর্তার স্ত্রী স্নিগ্ধা পাল। তার নামেও এ সহায়তার টাকা উঠানোর অভিযোগ উঠেছে। তার মা জোছনা পালও আছেন এই তালিকায়। ১২১ ও ১২২ নম্বরে থাকা তাদের নামে টাকা তোলা হয়েছে। স্নিগ্ধা পাল অনেক দিন ধরে ঢাকার মিরপুর-২ এ বসবাস করছেন। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মাগুরায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ৪৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিতরণে আরও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সহায়তা পাওয়া ৪৩৮ জনের তালিকায় আত্মীয়স্বজনের নাম ঢুকিয়ে টাকা তুলেছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রভাবশালীরা। এমনও ঘটেছে, ত্রাণের টাকা তুলেছে এক পরিবারের ছয়জন।

অথচ কবরী ঘোষের নাম তালিকায় থাকলেও তিনি টাকা পাননি। কবরী বলেন, ‘টিউশনি করে ও একটি কিন্ডারগার্টেনে ক্লাস নিয়ে সংসারের খরচ চালাই। টাকাটা পেলে আমার খুব উপকার হতো।’ অথচ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানাচ্ছেন, সহায়তাপ্রাপ্তদের সব টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদকের অসুস্থতা ও অনুপস্থিতির সুযোগে প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ অসাধু চক্র এ কাজ করেছেন। তারা নিজেদের আত্মীয়স্বজনের নাম ছাড়াও ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে তৈরি করা তালিকা ব্যবহার করেছেন।

মহম্মদপুর সদরের বাউল শিল্পী সিরাজ সরকার আক্ষেপ করে বলেন, ‘খেয়ে, না খেয়ে দিন কাটছে। দুই বছর কোনো গানের আসরে ডাক পাইনি। সরকার দুস্থ শিল্পীদের কল্যাণে অর্থ সহায়তা দিলেও তাতে আমার নাম নেই।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, মাগুরার শালিখা উপজেলার তালখড়ি গ্রামের আনন্দ চক্রবর্তী এবং তার বোন বীথি চক্রবর্তী পাঁচ বছর ধরে বিদেশে রয়েছেন। অথচ তালিকার ২৭২ ও ২৭৪ নম্বরে তাদের নাম দিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। তারা শিল্পকলা একাডেমির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর আত্মীয় হন। বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী নিজের ভাইবোন, ভাতিজাসহ অন্তত ১৩ জনের এই সহায়তার টাকা পাইয়ে দিয়েছেন। অথচ তাদের কেউ অসচ্ছল নন।

একইভাবে সংগীত শিক্ষক অজিত রায়ের এক ছাত্রীর পরিবারের ছয় সদস্যই পেয়েছেন সহায়তার টাকা। তবে অজিত রায় দাবি করেন, ‘আমার এলাকার একাধিক ব্যক্তি আবেদন করে টাকা পেয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে আমার শিক্ষার্থী। একটি পক্ষ ঈর্ষা থেকে আমাকে দায়ী করছে।’ 

বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার পুরো পরিবারই সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে জড়িত। তাই তারা সরকারি সহায়তা পেয়েছেন। ব্যক্তি আক্রোশ থেকে আমার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে।’ 

মাগুরার সাংস্কৃতিককর্মী রুপক আইচ, চিত্রশিল্পী শামসুজ্জামান পান্না, সংগীতশিল্পী বিকাশ সরকারসহ একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, প্রকৃত শিল্পীদের অনেকে করোনার কারণে অর্থসংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের জন্য দেওয়া সরকারের সহায়তার টাকা বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। 

মাগুরা জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম বলেন, লকডাউন শেষে দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হলে বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তালিকা তৈরি করে কেউ যদি উৎকোচ নেন, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 
 

শাহীন/বকুল 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়