ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাড়ির পাশে বঙ্গোপসাগর, তবু পানির জন‌্য হাহাকার 

ইমরান হোসেন, বরগুনা  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৬, ২৬ এপ্রিল ২০২১  
বাড়ির পাশে বঙ্গোপসাগর, তবু পানির জন‌্য হাহাকার 

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় গ্রামগুলোয় বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির সংকট বেড়েই চলেছে। এক কলস বিশুদ্ধ পানির জন‌্য গ্রামবাসীকে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় মাইলের পর মাইল পথ। অনেক সময় তাও মেলে না। স্থানীয়রা বলছেন, বাড়ির পাশে  বঙ্গোপসাগর, চারিদিকে এত পানি। তবু পানযোগ‌্য পানির জন‌্য তীব্র হাহাকার। 

ইউনিসেফ বলছে, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই, এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানুসহ ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকাগুলোয় প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে পানযোগ্য পানিবঞ্চিত। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সংকট সমাধানে পেরে উঠছে না তারা। 

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে পানিতে লবণের মাত্রা ৬০০ পিপিএম পর্যন্ত খাবার উপযোগী ধরা হয়। কিন্তু পাথরঘাটার ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের পরিমাণ ৩ হাজার পিপিএম। যা খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা দূরের কথা, থালা-বাসন ধোয়ার কাজেও ব্যবহার করা যায় না।

পাথরঘাটার হরিণঘাটা এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থানীয়  বাসিন্দা আজিজ মাতুব্বরের ১২ বছরের শিশু তানজিলা আজিজ ও তার বোন মারিয়া আজিজ (১০), প্রতিবেশী কাবুল মিয়ার কন্যা শিশু সায়রুন (১০), একই এলাকার কাদের মাঝির মেয়ে মলিনা (১০) খাবার পানি আনতে কলস নিয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। তাদের গন্তব্য জিনতলা। জিনতলার একটি পুকুরের পানি ফিল্টার করে খাবার উপযোগী করে দিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। সেখান থেকেই প্রতিদিনের খাবার পানি আনেন তারা। 

জানতে চাইলে তানজিলা আজিজ বলে, ‘করোনার সময় আমাদের স্কুল বন্ধ। আমরা প্রতিদিন প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে খাবার পানি আনি। অনেক পরিশ্রম হলেও খাবার পানি তো আনতেই হবে।’

তানজিলার মা সাবেকুন নাহার বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি ধরে রাখি। সেই পানি প্রায় ৯ মাস পান করতে পারি। রান্নার কাজেও ব্যবহার করি।  বাকি তিন মাস আমাদের কষ্ট করতে হয়। বাড়ির পাশেই বঙ্গোপসাগর। চারদিকে পানি আর পানি। কিন্তু সেই পানি আমরা ছুঁয়েও দেখতে পারি না। তাই তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়াই আমাদের একমাত্র উপায়।’

জিনতলা গ্রামে দেখা গেছে, বিশুদ্ধ পানির খোঁজে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটে চলেছেন ফরিদা বেগম, মিনারা বেগম, নাজমুন্নাহার কলি, সাবিকুন আরা নিপু, সোহেলী পারভীনসহ একাধিক গৃহবধূ। তারা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পাথরঘাটা উপজেলা বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত। এই এলাকায় রয়েছে একাধিক খাল। পর্যাপ্ত পানি থাকে সব সময়। কিন্তু পানিতে প্রচুর লবণ থাকায় তা খাওয়া যায় না। পানির মধ্যে বসবাস করি আমরা। তারপরেও খাবার পানির এমন সংকট।’
  
খাবার পানির তীব্র সংকট দূর করতে পাথরঘাটা উপজেলার সমুদ্র পাড়ের গ্রামগুলোতে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বসানো হয়েছে কিছু ফিল্টার। তবে, এসব ফিল্টারের পানিও জুটছে না সবার ভাগ্যে।

জিনতলা বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা অদিতা সরকার বলেন, ‘সাগর ও খালের পানি এতটাই লবণাক্ত যে, এই পানি দিয়ে থালাবাসন ধোয়ার মতোও অবস্থা নেই। এই পানি থালা-বাসনে লাগলেও ক্ষয় হতে থাকে।’

হাবিবুল বাশার মিঠু, আতিকুল ইসলাম শাওন, সাহিদা আক্তারসহ একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, ‘অনেক বছর ধরে বিকল হয়ে আছে জীনতলা ও হরিণঘাটার বেশিরভাগ ফিল্টার। অনেক জায়গায় যে পুকুরে বসানো হয়েছে ফিল্টার, সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। আবার বছর বছর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে পলিসহ সমুদ্রের লবণ পানি ঢুকে পড়ছে ঘর-বাড়ি, কৃষিজমি ও মিষ্টি পানির একমাত্র উৎস পুকুরগুলোতে। তাই প্রতিনিয়তই কমছে বিশুদ্ধ মিষ্টি পানির উৎসও।’

এ বিষয়ে পাথরঘাটা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘পাথরঘাটায় কোনো নলকূপ বসানো সম্ভব না। তাই এখানে সুপেয় পানির সংকট থাকে ১২ মাস। কেউ কেউ বৃষ্টির পানি ধরে রাখলেও তাতে বেশিদিন যায় না। সাগরের পানি এতটাই লবণাক্ত যে, এসব পানি না পারে কেউ কৃষিকাজে ব্যবহার করতে। না পারে গৃহপালিত পশুকে খাওয়াতে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর যদি পুকুর খনন করে নতুন করে এলাকায় এলাকা ফিল্টার বসিয়ে দিতো, তবে সংকট কিছুটা কমে যেতো।’ 

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জা নাজমুল হাসান  বলেন, ‘একদিকে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে। অন্যদিকে, উপকূলের পানিরস্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই চলমান প্রকল্প দিয়েও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তবে, আমরা এবার পাথরঘাটার ভূমি অফিসের মালিকানাধীন ৫০টি পুকুর খননের টেন্ডার নিয়েছি। এসব পুকুর খনন করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। পর্যায়ক্রমে ফিল্টারের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টাও করে যাচ্ছি আমরা।’

/এনই/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়