ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাবুই পাখির অস্তিত্ব হুমকির মুখে

শাহীন আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৮, ২৮ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৯:১২, ২৯ এপ্রিল ২০২১

‘‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই- “কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই; আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা 'পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।'' বাবুই হাসিয়া কহে- “সন্দেহ কি তায়? কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়; পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।’’ 

রজনীকান্ত সেনের বিখ্যাত স্বাধীনতার সুখ কবিতা আজও শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু কবিতার চিরচেনা বাবুই পাখির স্বাধীনতা আর সুখ দু’ই হুমকির মুখে। বসবাস উপযোগী পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে শৈল্পিক বাসার কারিগর ‘বাবুই পাখি’।

১০ থেকে ১৫ বছর আগেও মাগুরা সদর শালিখা, শ্রীপুর ও মহম্মদপুর উপজেলার সর্বত্র চোখে পড়তো বাবুই পাখি। এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। সারিবদ্ধ একহারা তালগাছের পাতায় ঝুলতে দেখা যায় না তাদের শৈল্পিক বাসা। কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয় না গ্রামীণ জনপদ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, কীটনাশকের ব্যবহার শিকারিদের দৌরাত্ম, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

বাবুই পাখি দেখতে অনেকটা চড়ুই পাখির মতো। গায়ে কালো দাগ, পিঠ তামাটে বর্ণের। ঠোঁট পুরো ও লেজ চৌকা। নিপুণ শিল্পকর্মে গড়ে তোলা কুঁড়েঘর-সদৃশ দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত অসংখ্য বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখি বিখ্যাত। নলখাগড়া ও হোগলা পাতা দিয়ে বাবুই বাসা বুনে থাকে। সেই বাসা যেমন আকর্ষণীয় তেমন মজবুত। শক্ত বুননের বাসা সহজে ছেড়া যায় না। প্রচণ্ড ঝড়ে ছিড়ে পড়ে না। অনেকে একে তাঁতি পাখি বলেন। এই পাখির বাসা মানুষের মানবিক ও সৌন্দর্য্য বোধকে জাগ্রত করার পাশাপাশি দেয় স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপ্রেরণা।

বাবুই পাখির বাসা উল্টানো কলসীর মতো। বাসা বানানোর জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ ছাড়ায়। পেট দিয়ে ঘসে গোল অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিন্মমুখী গর্ত থাকে। পরে এক দিকে বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা হয়। অন্যদিকে লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ তৈরি করে। কথিত আছে; রাতে বাসায় আলো জ্বালানোর জন্য বাবুই জোনাকি ধরে এনে নরম কাদায় গুঁজে দেয়।  বাবুই গ্রামের তাল, নারকেল, খেজুর, শিরিষ গাছ ও আখ ক্ষেতে দল বেঁধে বাসা বোনে। বাবুই পাখির মাংস সুস্বাদু হওয়ায় এক শ্রেণীর শিকারীরা বাসা ভেঙে ফেলে পাখি ধরে নিয়ে যায়। এ কারণেই এদের সংখ্যা রহস্যজনকভাবে কমে যাচ্ছে।

দেশি বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই-এই তিন প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই এর প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। তবে দেশি বাবুই গ্রামগঞ্জে এখনো কিছু দেখা যায়। এরা সাধারণত বিভিন্ন ফসলের বীজ, ধান, পোকা, ঘাস ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে। গ্রীষ্মকাল এদের প্রজনন ঋতু। আহার সংগ্রহে সুবিধা হয় এমন জায়গায় তারা বাসা তৈরির জন্য নির্বাচন করে। 

বাংলা একাডেমির লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংগ্রাহক ও মহম্মদপুর উপজেলার ইতিহাস ঐতিহ্যের গ্রন্থের লেখক মোহাম্মদ সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ মিলটন বলেন, ‘মাগুরা অঞ্চলে এক সময় বাবুই পাখি ও তার দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত বাসা দেখা যেত। তাল জাতীয় গাছে এই পাখি বাস করত। গাছ কমে যাওয়ায় বাবুই পাখির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়াই বাবুই পাখি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। বাবুই পাখি ও তার বাসা টিকিয়ে রাখতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।’

শালিখার তালখড়ি গ্রামের ইমরান হোসেন বলেন, ‘তালগাছ বাবুই পাখির ঘর-বসতি। তাল গাছ কমে যাওয়ায় এই পাখি এখন সচরাচর চোখে পড়ে না। এখন আর কেউ আগের মতো তালগাছ রোপণ করেন না।’

মহম্মদপুর সদরের শ্যামনগর কৃষক আব্দুর রাজ্জাক মিয়া বলেন, ‘এক সময় খেত ফসলের ক্ষতিকর পোকা বাবুইসহ বিভিন্ন পাখি খেয়ে ফেলত। পাখি কমে যাওয়ায় পোকার উপদ্রব বেড়ে গেছে।’

মাগুরার সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার (দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, ‘বাবুইসহ বিভিন্ন পাখির নিরাপদ আবাসভূমি রক্ষার্থে বনবিভাগ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষ করে বাবুই পাখির আবাস্থলের জন্য তাল গাছ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রামানন্দ পাল বলেন, ‘অতিথিসহ সব পাখি রক্ষার জন্য উপজেলা প্রশাসন সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। র্যালি ও মাইকিংসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ চোরা পাখি শিকারীদের নিবৃত করতে প্রচার চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

মাগুরা/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়