ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দুই বৃদ্ধা কেন গোয়াল ঘরে?

ইমরান হোসেন, বরগুনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২৬, ১ মে ২০২১   আপডেট: ১৯:২৭, ১ মে ২০২১
দুই বৃদ্ধা কেন গোয়াল ঘরে?

নিজের ঝুড়ে ভেঙে প্রতিবেশীর গোয়াল ঘরে আশ্রয় নেওয়া চন্দ্রভানু ও শাহাবানু

জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে উপহারের ঘর পাওয়ার আশ্বাসে বরগুনার আমতলীর গুলিশাখালী ইউনিয়নের দুই বৃদ্ধা মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁই ঝুপড়ি ঘর ভেঙে ফেলেছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রত‌্যাশিত ঘর তারা পাননি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কম্পিউটার অপারেটর এনামুক হক বাদশাহকে জনপ্রতি ১৫  হাজার টাকা দিতে না-পারায় মুজিববর্ষের উপহারের ঘর তারা পাননি।  ঝুপড়ি ঘর ভেঙে এখন দুই বৃদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীর গোয়াল ঘরে। 

বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের হরিদ্রাবাড়িয়া এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রামে মুজিববর্ষের উপহারের  মাত্র দুটি বসত ঘর আছে। যার একটি জাকির হোসেনের। হতদরিদ্র হিসেবে উপহারের ঘর পেলেও তার রয়েছে ৩ একর কৃষি জমি। এছাড়া, আছে মোটরসাইকেল ভাড়া দেওয়ার ব‌্যবসাও। এই প্রসঙ্গে জাকির হোসেন বলেন, ‘আমি এই ঘর পাওয়ার হকদার। তাই  পেয়েছি।’ 

অথচ একই এলাকায় ঝুপড়ি ঘরে থাকতেন ৮৪বছর বয়সী বিধবা বৃদ্ধা চন্দ্রভানু ও তার বিধবা মেয়ে ৬৪ বছরের বৃদ্ধা শাহাবানু।  তাদের দুজনকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেওয়ার কথা বলে ঝুপড়ি ভেঙে ফেলতে বলেছিলেন এনামুল হক বাদশাহ।

চন্দ্রাভানু ও শাহাবানু বলেন, ‘এনামুলের কথা মতো আমরা ঝুপড়িটা ভেঙে ফেলি। এর এনামুল আমাদের কাছে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। ওই টাকা দিতে না পারায়  আমাদের আর ঘর করে দেননি। বাধ‌্য হয়ে প্রতিবেশীর গোয়ালঘরে বসবাস করছি।’

চন্দ্রবানু ও শাহবানুর মতো অনেকে হতদরিদ্র রয়েছেন আমতলীতে। তারাও পাননি উপহারের ঘর।  স্থানীয় সোবহান খলিফা, আবুল হোসেন শিকদার, আবি আব্দুল্লাহ বাচ্চু, গোলনাহার বিবি, সাফিয়া বেগম বলেন, ‘সারা জীবন কষ্টে কাটিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এসব ঘর আমাদেরই পাওয়ার কথা ছিল। তবে, আসরা এনামুলকে তার দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে পারিনি। তাই ঘরও পাইনি। ঘর পেয়েছেন এলাকার ধনীরা।’

পুরো ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, হতদরিদ্রদের ঘর পাওয়ার তালিকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কম্পিউটার অপারেটর এনামুল হক বাদশার  চাচা-মামাতো ভাই, ভগ্নিপতি ও বন্ধু মিলিয়ে অন্তত ৮ জন রয়েছেন। এই ৮ জনের প্রত‌্যেকের ন‌্যূনতম ৩ একর করে জমি রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। 

দুই বৃদ্ধার ঝুপড়ি ঘর ভেঙে ফেলার খালি জায়গা

এই বিষয়ে গুলিশাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমান মাস্টার বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী যারা হতদরিদ্র ভূমিহীন, তারাই এসব সহায়তার ঘর পাবেন। তবে, এই ইউনিয়নে একদম তার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। স্বাবলম্বীরা পেয়েছেন সব ঘর। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের কম্পিউটার অপারেটর এনামুল হক বাদশা টাকা তুলেছেন। যারা টাকা দিয়েছেন, তারাই ঘর পেয়েছেন।’

এদিকে, ঘর বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২৩ এপ্রিল জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন ইউনিয়ন ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা কামাল রাঢ়ী। এই প্রসঙ্গে কামাল রাঢ়ী বলেন, ‘আমার অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন‌্য পরদিনই ইউএনও’র লোকজন আমাকে ডেনে নেন তার বাসায়। সেখানে তার কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন ইউএনও।  প্রাণ ভয়ে পরদিন অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি দিলে সে প্রাণের ভয়ে ইউএনও’র কাছে ক্ষমা চেয়ে অভিযোগ তুলে নেওয়ার কথা বলে চলে আসে। পরে সে আমতলী সাংবাদিক ইউনিয়নে সংবাদ সম্মেলন করে ইউএনও আসাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে মুখ খোলেন।’

অভিযোগের বিষয়ে অপারেটর এনামুক হক বাদশা মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে এলাকায় কাজ করেছি। আমার এলাকায় যারা প্রকৃত গরিব তাদের নাম তালিকায় আছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। গরিবদের মধ্যে আমার স্বজনরাও আছে। আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। এরপরও এটি নিয়ে জেলা প্রশাসন তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত চলমান, তাই এই বিষয়ে আমি এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারবো না।’

এই বিষয়ে রাইজিংবিডিকে মুঠোফোনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘এসব বিষয়ে কিছুই বলার নেই, আমি করোনার ২য় ডোজ টিকা নিয়েছি। আমার শরীর ভালো না।’এরপরই তিনি ফোন কল কেটে দেন।

তবে, জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। জেলা প্রশাসন এই বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। প্রমাণ পেলেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই অভিযুক্ত নাজমুলকে আমতলী উপজেলা পরিষদ থেকে বদলি করে বেতাগী উপজেলা পরিষদে দেওয়া হয়েছে। আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি দেবে জেলা প্রশাসন।’

/এনই/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়