শ্রমিক দম্পতির সংসারে এখন শুধুই অনটন
সাভার প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
স্বামী খায়রুল ইসলাম পোশাক কারখানায় চাকরি করেছেন ২০ বছর, আর স্ত্রী সাদিয়া বেগমও প্রায় ৯ বছর কাজ করেছেন। ২০০৫ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এই দম্পতি। দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষেও অভাব-অনটন ও কষ্ট পিছু ছাড়েনি তাদের।
স্বামী খায়রুল ২০১০ সালে কারখানা থেকে ছাটাই হন। আর ২০১৬ সালে চাকরি চলে যায় স্ত্রী সাদিয়ার। খায়রুলের চাকরি চলে যাওয়ার পরেই সংসারে শুরু হয় চরম আর্থিক টানাপোড়েন। বসে থাকেননি খায়রুল। সামান্য মজুরিতে কখনও রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করেছেন, কখনও প্রখর রোদে ইট ভেঙেছেন। স্ত্রীর চাকরি চলে যাওয়া অবধি বাসা ভাড়া আর দুই ছেলের ভরণপোষণ চালিয়ে কোনভাবে কেটেছে সংসার। কিন্তু স্ত্রী চাকরি হারানোর পর সংসারে জেঁকে বসে অভাব। সঞ্চয়ও করতে পারেননি এই দম্পতি। বড় ছেলে গার্মেন্টে চাকরি নিয়ে বিয়ে করে হয়ে যায় আলাদা। এখন ৯ বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন এই শ্রমিক দম্পতি।
সাভারে আশুলিয়ার পলাশবাড়ী এলাকায় একটি বাড়ির ছোট্ট কক্ষে বসবাস খায়রুল-সাদিয়া দম্পতির। খায়রুল এখন ভ্যানে ফেরি করে সবজি বিক্রি করেন। আর স্ত্রী সাদিয়ার বয়স বেড়ে যাওয়ায় কর্মহীন।
খায়রুল বলেন, ঢাকায় আসছি নব্বই সালে। তখন ড্রাগন নামের ফ্যাক্টরিতে সোয়েটারের কাজ শিখি। বেতন ৩২৫ টাকা। রামপুরা ফোরস্টার নামের আরেক ফ্যাক্টরিতে তবছর দুয়েক চাকরি করি। তারপর সেখানেই রূপা ফ্যাশনে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পরে ২০০০ সালে আমি আশুলিয়াতে আসি। এখানে আরেকটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। ২০০৩ সালে ইপিজেডে র্যাংকন স্যোয়েটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেই। ওভারটাইমসহ সব মিলিয়ে ৫ হাজার টাকা বেতন পাইতাম। সে সময় সাদিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়। ২০০৪ সালে ইপিজেডের ফ্যাক্টরি থেকে আমাদের আউট করে দেয়। পরে জামগড়াতে রিংসাইন ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেই। কিন্তু ২০০৬ সালে ফ্যাক্টরি ক্লোজ করে দেয়। অনেক কষ্ট করে পল্লীবিদ্য এলাকার মনোরমা সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেই। ২০১০ সালে ওই ফ্যাক্টরি থেকেও আমাদের অনেক শ্রমিককে বিনা কারণে ছাটাই করে। সীমিত কিছু টাকা-পয়সা দেয়। তারপর থেকে যেখানেই চাকরি করি ওই বেতনাদি পেতে জোরজুলুম করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের চাকরি জীবনে আমার সংসার অভাব অনটনেই চলেছে। যদি বাচ্চার অসুখ হইছে, ওই মাসে তার চিকিৎসা করতে গিয়ে আমার আর চাউলের পয়সা হয় নাই। এইভাবেই খুব কষ্ট করে দিনযাপন করেছি। আর এখনতো বয়স হয়েছে। অনেক ঘোরাঘুরি করে চাকরি হচ্ছে না, তাই এখন শাকের ব্যবসা করি। কমবেশি দিন আনি দিন খাই মতনই চলছে। এমনও আছে কোন মাসে ঘর ভাড়া দিতে পারি নাই। এই অবস্থায় তিন-চার মাসের ঘর ভাড়াও এখন বাকী পড়েছে আমার।
এসময় তিনি সরকার ব্যবস্থার প্রতি আক্ষেপ করে বলেন, শুধু কষ্ট ছাড়া আর কোনো পথ দেখিনি। আগেও কষ্ট করছি, এখনও কষ্টই করতেছি। এখন যদি আমি হঠাৎ অসুখে পড়ি বা আমার কোন দুর্ঘটনা ঘটে। তাহলে দেখার কোন লোক নাই। আল্লাহর কাছে বলি, যাতে কোন দুর্ঘটনা না দিয়া একবারে নিঃশ্বাস ত্যাগ করায়।
সাদিয়া বেগম বলেন, নয় বছর গার্মেন্টসে চাকরি করছি। যে বেতন পাইছি ওই বেতনে চলে নাই। অনেক কষ্ট করছি। এখনও অনেক কষ্টের মধ্যেই আছি। কোন পুঁজি নাই। টাকা পয়সা-ব্যাংক ব্যালেন্স নাই। এখন আরো খারাপের দিকেই যাইতেছি।
গামের্ন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, এই শ্রমিক দম্পতির করুণ পরিণতির কারণ বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের কোন সেফটির ব্যবস্থা নেই। যেমন ভবিষ্যত তহবিল কিংবা একটানা কোথাও কাজ করার সুযোগ নেই। কারণ অধিকাংশ কারখানাতে আমরা দেখি, একজন শ্রমিকের চাকরির ধারাবাহিকতা গড়ে ৫-৭ বছর। যার কারণে শ্রমিকরা যে ভবিষ্যত তহবিল গঠন করবে সেই সুযোগটা আসলে নেই। আর কারখানাতে তাদের মজুরি এতই কম দেওয়া হয় যে প্রতি মাসে সেই টাকা দিয়ে চলাটাই কষ্টের। যার কারণে তাদের ভবিষ্যত তহবিল গঠন করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, যে শ্রমিকরা একসময় সমাজে বোঝা দূর করার জন্য সমাজকে ভালো রাখার চিন্তা করে গার্মেন্ট শিল্পে আসছিলো। কিন্তু একটা সময় যাদের বয়স ৩৫ হয়ে যাচ্ছে তারাই আবার চাকরি হারিয়ে সমাজের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে এই দায়টা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে এবং রাষ্ট্রকে শ্রমিকদের জন্য এমন কোন কল্যাণমূলক ব্যবস্থা করতে হবে। যারা গার্মেন্ট শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি কাজ করবে তাদের জন্য সরকার ভবিষ্যত সেফটির ব্যবস্থা করবে। কারণ এই গার্মেন্ট শ্রমিক রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যার কারণে এই শ্রমিকদের ভবিষ্যত যদি ভালো না হয় তাহলে অন্য শ্রমিকরা আর গ্রাম থেকে আসবে না।
তিনি বলেন, এখানে বিজিএমইএর করণীয় হচ্ছে, প্রত্যেকটা কারখানায় প্রত্যেকটা শ্রমিকদের যাতে সার্ভিস ব্যয় চালু হয় সেটার যথাযথ ব্যবস্থা করা। যেটা শ্রম আইনে করে পরিষ্কার বলা আছে। ওই সার্ভিস ব্যয়ে শ্রমিকদের চাকরির ধারাবাহিকতা যে, কোন কারখানায় কত বছর চাকরি করছে সে বিষয়টা উল্লেখ থাকবে। আর তার চাকরির ধারাবাহিকতায় এবং চাকরির বয়স নির্ণয় করে ওই শ্রমিকটা যখন কর্ম হারাবে বা অবসরে যাবে। তখন তাকে একটা ফান্ড থেকে পেনশন আকারে ধারাবাহিক আকারে একটা অর্থ সহায়তা দেয়া। যাতে সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্তত সেই পেনশনের টাকা দিয়ে তার জীবনধারণ করতে পারে। এই দায়িত্ব সরকার কিংবা বিজিএমইএকেই নিতে হবে।
আরিফুল/টিপু
আরো পড়ুন