ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কুড়িগ্রামে প্রেম করে বিয়ে করা স্বামীর হাতেই নির্মম নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০০:২৬, ৩ মে ২০২১   আপডেট: ০১:২৯, ৩ মে ২০২১
কুড়িগ্রামে প্রেম করে বিয়ে করা স্বামীর হাতেই নির্মম নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ

সুখের সংসার বাঁধতে কিশোরী বয়সেই মনের মানুষকে বিয়ে করেছিলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণী ইউনিয়নের তামান্না বেগম (২২)। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই বুঝতে পারেন স্বামী মাদকাসক্ত। ভালোবেসে বিয়ে করলেও পরবর্তীতে যৌতুকের দাবিতে শুরু করেন স্ত্রীর ওপর নির্মম নির্যাতন। তারপরও স্বামীর সংসার আকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলেন এই গৃহবধূ। এরই মধ্যে বছর ঘুরতে না ঘুরতে গর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করেন তিনি। মা হওয়ার স্বপ্নে আবারও বিভোর হয়ে পড়েন। কিন্তু থেমে থাকেনি নির্যাতন। ভেবেছিলেন হয়তো সন্তানের জন্ম হলে মায়ায় পড়ে নির্যাতন বন্ধ হবে। ফুটফুটে ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যায় সবকিছু। যৌতুকের দাবিতে আবারও কথায় কথায় চলতে থাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। নির্যাতনে স্বামীর সাথে যোগ দেন শ্বশুর-শাশুড়ীও। পরবর্তীতে ওই গৃহবধূর গর্ভে আবারও সন্তান আসলে তা ৩ মাসের মাথায় নষ্ট করে দেন।

স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ীর এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণী ইউনিয়নের স্কুল শিক্ষক মেসবাহুল আজমের মেয়ে তামান্না বেগম। থানায় অভিযোগ করে তিনি বলেন, মামলা করলেও আসামি গ্রেফতারে টালবাহানা করছে পুলিশ। বরং আসামিদের হুমকি-ধামকিতে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

তামান্না বেগমের স্বামীর নাম নাইমুল ইসলাম লিমন (২৬)। তিনি উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণী ইউনিয়নের দাড়িকা গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে। নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূ জানান, প্রেমের বিয়ে হলেও বিয়ের কিছুদিনের মাথায় তিনি জানতে পারেন তার স্বামী মাদকাসক্ত। এ নিয়ে বাধা দিতে গেলে তার ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। তারপর শুরু হয় যৌতুকের চাপ। প্রথম সন্তানের জন্ম হলে মুখবুজে সব সহ্য করলেও যৌতুকের চাপে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। স্বামীর সঙ্গে যোগ দেন শ্বশুরও। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়িতে ফিরে গিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চাইলে উভয় পরিবারের আলোচনায় ‘মীমাংসা’ করে আবারও সংসার শুরু করেন তিনি। কিন্তু সাময়িক বিরতি দিয়ে আবারও নির্যাতন শুরু হয়।

গৃহবধূ তামান্না আরো বলেন, স্বামী তো মারেই, সঙ্গে যোগ দেন শ্বশুর-শাশুড়ীও। একদিন শ্বশুর রড দিয়ে আঘাত করে আমার বাঁ হাতের হাড় ভেঙে দেন। অসহনীয় নির্যাতনে বাবার বাড়ি চলে গেলে পরবর্তী সময়ে আবারও লিখিত অঙ্গীকারনামায় সমঝোতা করে আমাকে স্বামীর সংসারে নিয়ে আসা হয়। কিছুদিন পর আবারও যৌতুক চেয়ে নির্যাতন শুরু হয়। এর মধ্যে আমি দ্বিতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা জানার পর আমার স্বামী আমাকে সন্তান নষ্ট করার চাপ দিতে থাকে। আমি রাজি না হলে গত ২১ এপ্রিল আমাকে মারতে শুরু করে। এ সময় আমার শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে বাধা না দিয়ে উল্টো তাকে সহায়তা করতে থাকেন। আমার স্বামী তলপেটে আঘাত করলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তারা আমাকে চিকিৎসার কথা বলে উলিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পেছনে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে একজন ধাত্রীর মাধ্যমে জোর করে গর্ভপাত করায়। আমার গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করে।

নির্যাতনের শিকার এই গৃহবধূ অভিযোগ করে বলেন, গর্ভপাতের কারণে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে আমি বিষয়টি আমার বাবা-মাকে জানাই। খবর পেয়ে আমার বাবা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে উলিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে গত ২৬ এপ্রিল আমি উলিপুর থানায় মামলা করি। কিন্তু এখন মামলা তুলে নিতে আমাকে ও আমার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি অব্যাহত রেখেছে। মামলা হলেও আসামি গ্রেফতারে টালবাহানা করছে পুলিশ। তাহলে কোথায় বিচার পাবো আমি?’

স্ত্রীকে নির্যাতনের ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত স্বামী নাইমুল ইসলাম লিমনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, গত ২৬ এপ্রিল ভুক্তভুগী গৃহবধূ বাদি হয়ে উলিপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলা নং-২২। এতে আসামি হিসেবে গৃহবধূর স্বামী নাইমুল ইসলাম লিমন ও শ্বশুর আব্দুল হামিদসহ চার জনের নাম উল্লেখ করা হয়। মামলার পর প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও পর্যন্ত কোন আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি। নির্যাতিত গৃহবধূর অভিযোগ, আসামিরা টাকার বিনিময়ে পুলিশকে থামিয়ে রেখেছে।

এ ব্যাপারে উলিপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমতিয়াজ কবিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও আসামি গ্রেফতারে গড়িমসির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্য নেওয়ার পাশাপাশি আসামি গ্রেফতারে চেষ্টা করছে পুলিশ।

ভুক্তভোগী গৃহবধূর গর্ভপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। তাদের মতামত পেলে এ নিয়েও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সৈকত/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়