ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভালো নেই সুনামগঞ্জের অন্ধ শিল্পী গোলাপ মিয়া

আল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১১, ১০ মে ২০২১   আপডেট: ১৩:৪৬, ১০ মে ২০২১
ভালো নেই সুনামগঞ্জের অন্ধ শিল্পী গোলাপ মিয়া

অন্ধ শিল্পী গোলাপ মিয়া উপার্জনের একমাত্র উপায় ‘গান’। গান গেয়ে পাওয়া উপার্জনেই চলছিলো তার সংসার। করোনার মহামারি পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে সাত সদস্যের সংসার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এই অন্ধ শিল্পী।

গান গাওয়ার সুবাদে সুনামগঞ্জে গোলাপ মিয়া অনেকের কাছেই পরিচিত। তিনি সপ্তাহে পাঁচ দিন সুনামগঞ্জ আদালত চত্বর এবং দুইদিন হালোয়ারঘাটে নৌকায়সহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় গান গেয়ে বেড়াতেন। প্রতিদিন গান গেয়ে চার থেকে পাঁচশত টাকা উপার্জন করতে পারতেন তিনি। এতে মোটামুটি ভালই চলছিলো তার সংসার। মহামারী করোনা হানা দিতেই লকডাউনের কারণে ভাটা পড়ে তার রোজগারে। আয়-রোজগার না থাকায় বিপর্যস্ত তার পরিবার। কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে চলছে তার সংসার।

একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে পবিত্র রমজান আসার পর গান গাওয়া একেবারেই বন্ধ। আয় রোজগার নেই। ঘরেও খাবার নেই। পাননি কোনো ত্রাণ সহায়তা। বাধ্য হয়ে স্ত্রীসহ ভিক্ষায় বের হন রাস্তায়। এভাবে কোনোমতে বেঁচে আছে তার সাত সদস্যের সংসার।

গোলাপ মিয়া জানান, ১৫ বছর বয়স থেকেই একটি রোজাও ছাড়েননি তিনি। এবার পহেলা রমজান থেকে এ পর্যন্ত সবজি ও ডাল দিয়ে খেয়ে রোজা রাখছেন তিনি ও তার পরিবার।

তিনি জন্মান্ধ নন, ১৫ বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে চোখ হারান সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের খায়েরগাঁও এলাকার মৃত দেওয়ান আলীর ছেলে গোলাপ। এখন তার বয়স ৫০ বছর। সংসারে রয়েছে প্রতিবন্ধী স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই মেয়ে। বড় মেয়ে পাশের গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি চার সন্তান মাদ্রাসা ও স্কুুলে লেখাপড়া করছে। করোনায় তাদের লেখাপড়াও বন্ধ রয়েছে বলে গোলাপ মিয়া জানালেন।

আলাপকালে এই অন্ধ শিল্পী খুব হতাশার স্বরে বলেন, করোনা ও লকডাউনের কারণে আদালত বন্ধ। রাস্তা-ঘাটে চলাচল করা যায়না। আগে আদালত এলাকায় গান গাইতাম। গান শুনে মানুষ যা দিতো তা দিয়ে চলতো তার সংসার। কিন্তু এখন আদালত বন্ধ থাকায় মানুষ আসে না। রোজগার নাই। খুব কষ্টে দিন কাটছে।

অন্ধ শিল্পী বলেন, সুনামগঞ্জের ডিসি সাবের কাছে গিয়েছিলাম সাহায্যের জন্য। তিনি পাঠালেন পৌরসভার মেয়রের কাছে। মেয়র সাহেব বললেন তিনি সাহায্য করতে পারবেন না। তার ত্রাণ সামগ্রী শেষ হয়ে গেছে। আবার ডিসি সাহেবের কাছে যেতে বললেন। কিন্তু এই হয়রানির চাইতে না যাওয়াই ভালো। তাই আর যাই নাই।

তিনি বলেন, রমজানের প্রথমদিকে একটি বিদেশি সংস্থা চ্যানেল এস ইউকে শুধুমাত্র সাহায্য করেছে। এগুলো দিয়ে কয়েকদিনের খাবার চলছিলো। কিন্তু আর কোনো সাহায্য পাইনি। শুনলাম সরকার গরিব মানুষদের সাহায্য দেয় কিন্তু আমরা পাই না। তাইলে এই সাহায্য কে পাচ্ছে?

গোলাপ মিয়ার স্ত্রী হুসনা বেগম বলেন, আগে তার সংসার চলছিলো ভালো। করোনা-লকডাউন আসার পর এখন কোনো রোজগার নাই। খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে। রমজান মাস আসার পর থেকে বেশি কষ্টে দিন যাচ্ছে। এখন ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছেন। পহেলা রমজান থেকে আজ পর্যন্ত ভালো করে একবেলা খেতে পারেননি।

সচেতন নাগরিক কমিটির সহসভাপতি ও চ্যানেল এস ইউকের জেলা প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট খলিল রহমান বলেন, গোলাপ মিয়া গান গেয়ে সংসার চালাতেন কিন্তু করোনার আসার পর তিনি খুবই কষ্টে আছেন। আমি চ্যানেল এস ইউকের পক্ষ থেকে প্রতিবছর তাকে সহায়তা করে আসছি। এবারও ত্রাণ সহায়তা করেছি।

জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুচিত্রা রায় বলেন, গোলাপ মিয়া খুবই ভালো একজন শিল্পী। গোলাপ মিয়া প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। করোনা-লকডাউনে হয়তো একটু কষ্টে আছে। আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি।

সুনামগঞ্জে এই অন্ধ শিল্পীর গান অনেক বেশি পছন্দ করেন সাধারণ মানুষ। তার গান শুনে মুগ্ধ হন। অন্ধ কীভাবে হলে এবং গান কার কাছ থেকে শিখলেন জানতে চাইলে গোলাপ মিয়া বলেন, ১৯৭১ সালে জন্ম আমার। ১৫ বছর বয়সে চোখ হারানোর পর পুরো পৃথিবীটাই আমার কাছে অন্ধকার হয়ে যায়। এ সময় মানুষ হিসেবে বাঁচতে এবং জীবন চালাতে পাশে দাঁড়ান আমাদের খায়েরগাঁও স্কুলের তৎকালীন শিক্ষক কুমিল্লার রশিদ মাস্টার। তিনি আমাকে ২০/২৫টা গান শেখান। এরপর তিনি পাঠিয়ে দিলেন গান শেখার জন্য ঢাকায়। সেখানে ছয় মাস থেকে শিল্পী মুকুল সরকার আমাকে গান চর্চা করান। পরে বেশ কয়েকটি গান শিখে বাড়িতে চলে আসি। এরপর থেকে এলাকায় গান গেয়ে জীবন-জীবিকা চালাই। নিজেও বেশ কয়েকটি গান বেঁধেছেন।

‘ও গো দয়াল এলাহি তুমি দুটি নয়ন আমার দিলায় না, ও খুদা তুমার হইলো পছন্দ আমারে বানাইলা অন্ধ, তুমার লিলা কেউ বুঝিতে পারে না পারে না’ এরকম দরদভরা গানের মধ্য দিয়ে আজো বেঁচে আছেন এই সুনামগঞ্জের বাউল।

সুনামগঞ্জ/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়