ফেসবুকে প্রেম, বিয়ের ৮ মাস পর কলেজছাত্রী খুন
বগুড়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
নাজনীন ও সাকিব
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয়ের পর প্রেম। এক পর্যায়ে তা গড়ায় বিয়েতে। কিন্তু বিয়ের মাত্র আট মাস যেতে না যেতেই হত্যার শিকার হলেন বগুড়ার নাজনীন আক্তার। তিনি বগুড়ার সৈয়দ আহম্মদ কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।
বুধবার (২ জুন) সকাল ১০টায় বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউনিয়নের হরহর গ্রামের একটি ধানক্ষেত থেকে নাজনীনের বস্তাবন্তি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এর আগে নাজনীন আক্তারের বাবা আব্দুল লতিফ প্রামানিক মেয়ে নিখোঁজ জানিয়ে বগুড়া সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পুলিশ নিহত নাজনীন আক্তারের স্বামী সেনা বাহিনীর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সাকিব হোসেনকে বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আটক করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত নাজনীনের বাড়ি বগুড়া সদর থানার সাবগ্রাম উত্তরপাড়া এলাকায়। তার বাবা মুদি ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ প্রামানিক। সাকিব হোসেনের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়নের চর উত্তর ভূতেরদিয়া এলাকার নতুন জাহাপুর গ্রামে। তার বাবা ভ্যান চালক আব্দুল করিম হাওলাদার।
নিহত নাজনীন আক্তারের ভাই মেহেদী হাসান জানান, তার বোনের সঙ্গে সাকিবের প্রায় দেড় বছর আগে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়। এরপর তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাকিবের বাবা বড় ব্যবসায়ী, তাদের চার তলা বাড়ি আছে। এসব তথ্য নাজনীন ও তার পরিবারকে জানান সাকিব। এক পর্যায়ে নাজনীনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন সাকিব।
নাজনীনের পরিবার থেকে বিষয়টি সাকিবের পরিবারকে জানাতে বলা হয়। সেসময় সাকিব জানান, এখনই তার পরিবারকে বিষয়টি জানানো যাবে না। জানালে তার পরিবার মেনে নেবে না। বিয়ের পর জানাবে বলে জানান তিনি। নাজনীনের চাপে বিষয়টি মেনে নেয় তার পরিবার।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাকিব তার পরিবারের সদস্য ও নিজ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে নাজনীনকে গোপনে বিয়ে করেন। বিয়ের সময়ও প্রতারণার আশ্রয় নেন সাকিব। তার বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়নের চর উত্তর ভূতেরদিয়া এলাকার নতুন জাহাপুর গ্রামে হলেও কাবিননামায় তিনি গৌরনদী উপজেলার জালোকাঠি, আগলঝরা এলাকা বলে উল্লেখ করেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কাবিননামায় উল্লেখ করা ঠিকানাটি একেবারেই ভূয়া।
নাজনীনের পরিবার থেকে জানানো হয়, গত সোমবার (২৪ মে) বেলা ১১টার দিকে সাকিব নাজনীনকে ফোন করেন। তিনি জানান তার বাবা খুব অসুস্থ, বাড়ি যেতে হবে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নাজনীনকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। সেজন্য নাজনীনকে বগুড়ার গোদারপাড়া চারমাথা বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলেন।
নাজনীন বিষয়টি তার পরিবারকে জানালে পরিবার সম্মত হয়। ভাই মেহেদী হাসান নাজনীনকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে যান। সাকিব ও নাজনীন কুমিল্লার একটি বাসে ওঠেন। তারা ঠিকমত বাড়ি পৌঁছেছে কি না তা জানতে নাজনীনের পরিবার একাধিকবার নাজনীন ও সাকিবের মোবাইলে ফোন করে। তবে তাদের দুজনেরই মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পরে তারা সাকিবের মায়ের মোবাইলে ফোন করেন। ফোনটিতে রিং হলেও কেউ রিসিভ করেনি। ঘটনার দুদিন পর সাকিব নাজনীনের বাবাকে ফোন করেন। ফোনে তিনি নাজনীনের বাবাকে বলেন, ‘আপনার মেয়ে পালিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আপনার কাছে গেছে। আমার স্ত্রীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন।’
এ ঘটনায় নাজনীনের বাবা আব্দুল লতিফ প্রামানিক বাদি হয়ে গত বুধবার (২৬ মে) বগুড়া সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি বগুড়া সেনানিবাসের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদেরকেও ঘটনাটি জানান। তারা সাকিবের ছুটি বাতিল করে দ্রুত তাকে কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেন।
নির্দেশ পেয়ে সাকিব কর্মস্থলে যোগদান করেন। পরে সেনাকর্মকতাদের জিজ্ঞাসাবাদে নাজনীন খুনের ঘটনা বেরিয়ে আসে। সেনা কর্তৃপক্ষ তখন সাকিবকে চাকরিচ্যুত করে বগুড়া সদর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন।
সাকিব হোসেন পুলিশকে জানান, বগুড়া থেকে বাসযোগে নাজনীনকে নিয়ে ওইদিন রাতে বরিশাল পৌঁছান তিনি। গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর বন্দর সংলগ্ন হরহর গ্রামে তার ভ্যান চালক বাবার ভাড়া বাসায় ওঠেন।
সাকিবের এ দরিদ্র অবস্থা দেখে নাজনীন ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গালিগালাজ করেন। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওইদিন রাত ১১টায় সাকিব একটি নাইলন দড়ি দিয়ে নাজনীনের গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করেন। পরে বালিশ চাপা দিয়ে নাজনীনকে হত্যা করেন। রাত দেড়টার দিকে নাজনীনের লাশ ওই বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্কের মধ্যে ফেলে দেন সাকিব।
বগুড়া সদর থানা পুলিশ জানায়, সাকিবের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী নাজনীনের লাশ উদ্ধারের জন্য বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) মো. আবুল কালাম আজাদ, এসআই মো. গোলাম মোস্তফা, এএসআই মো. উজ্জল হোসেন সঙ্গীয় ফোর্সসহ সাকিবকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার (৩১ মে) রাতে গৌরনদী মডেল থানায় পৌঁছান।
মঙ্গলবার (১ জুন) ভোরে গৌরনদী মডেল থানা পুলিশের সহয়তায় তারা উদ্ধার তৎপরতা চালান। সাকিবের দেওয়া বর্ননা অনুযায়ী মঙ্গলবার সেপটিক ট্যাংকের ভেতরের পানি সেচ করে সেখানে দুটি নখ ও শরীরের চামড়ার কিছু অংশ পেলেও নাজনীনের লাশের কোনো হদিস মেলেনি।
থানা পুলিশ জানায়, সাকিব আটক হয়েছে এ বিষয়টি জানার পর সাকিবকে পরিবার নাজনীনের লাশ সেপটিক ট্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলে। সেকারণে লাশ খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। পরবর্তীতে বুধবার (২ জুন) সকাল ১০টায় বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউনিয়নের হরহর গ্রামের একটি পুকুর পাড় থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ জানান, ৩০ মে সকালে নিহত নাজনীনের স্বামীকে আটকের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গৌরনদী থানা পুলিশের সহযোগিতায় লাশ খোঁজা হচ্ছিল। বুধবার সকালে বগুড়া সদর থানার একটি টিম লাশ উদ্ধার করে। আসামি থানায় আছে। লাশ নিয়ে আসা হচ্ছে। পরে মামলা হবে।
এদিকে গৌরনদী থানার ওসি মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘বাটাজোর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন সংলগ্ন একটি ধানক্ষেত থেকে বস্তাবন্দি এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের ধারণা সেটি নাজনীনের লাশ। নাজনীনের বাবা মাকে বরিশালে আসতে বলা হয়েছে। তবে লাশের খোঁজ না পেয়ে বগুড়া থেকে আগত পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার আসামিকে নিয়ে ফিরে গেছে।
এনাম আহমেদ/জে.কে. স্বপন/সনি
আরো পড়ুন