ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সম্ভাবনা আর দুর্দশার বহুরূপী তিস্তা বর্ষার শুরুতেই ভাঙলো ৩ বার

ফারুক আলম, লালমনিরহাট প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ১৭ জুন ২০২১   আপডেট: ১১:৫০, ১৭ জুন ২০২১
সম্ভাবনা আর দুর্দশার বহুরূপী তিস্তা বর্ষার শুরুতেই ভাঙলো ৩ বার

বহুরূপী তিস্তা। বর্ষাতে এক রূপ, আর শুষ্ক মৌসুমে আরেক রূপ। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার চরাঞ্চল সবুজ সমতলের রুপ নেয়। গ্রীস্মের পরপরই হঠাৎ হঠাৎ পানি বাড়া কমাতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন চরাঞ্চলের কৃষকসহ তিস্তাপাড়ের মানুষ। নদী ভাঙন আর হঠাৎ পানি বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে যায় চরাঞ্চলের ফসল। তবুও হাল না ছাড়া মানুষগুলো তিস্তায় চাষাবাদ করে। ৬ মাসের চাষাবাদে তাদের জীবন চলে। বাকি ৬ মাস কর্মসংস্থানের জন্য চলে যায় বড় বড় শহরগুলোতে।

তিস্তাপড়ের লতিফ মিয়া বলেন, আমরা চরে চাষ করা শিখে গেছি। শুষ্ক বালুতে প্রথমে আলু, পরেরবার বাদাম, তারপরের বার যা দিবো তাই ফলবে। সরকার যদি বাঁধ দিয়ে আমাদের কাছে আরও খাজনা নিতো, তাও আমরা দিতাম।

নূর মোহাম্মদ। বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। তার জীবনে ২৭ বার বাড়ি ভেঙেছে তিস্তায়। গত বছরও বাড়ি ভেঙেছে। এবারও ভাঙনের মুখে। এবার তিনি অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন। কিন্তু এবারও তার বাড়ি ভাঙনের ঠিক মুখেই রয়েছে। এবছর কয়েক দফায় একাই ২ হাজার ৭০০ টাকার বাঁশ কিনে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।

৬৫ বছর বয়সী বিধবা হালিমা বেগম বলেন, ৫ সন্তানের তিন সন্তানই মারা গেছে। এখন এক ছেলে এক মেয়ে আছে। ছেলে চট্টগ্রামে কাজ করে। মেয়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ কারে। তিনি একা তিস্তার চরে থাকেন। 

তিনি বলেন, ৫০ বছরের সংসার জীবনে কমপক্ষে ১৫ বার তিস্তার ভাঙন দেখেছেন। তিস্তার ডান তীরের কাছে ১৬ বছর ছিলেন। অনেক গাছপালা, গরু-মহিষে গোছালো সংসার ছিল। সব ভেঙে গেছে। তিস্তার মূল নদী অনেক দূরে ছিল। শ্বশুর, শাশুড়ি, সন্তানদের কবরের কোনো চিহ্নই নেই।

কৃষক ইয়াকুব আলী (৬৫) বলেন, অনেকবার তিস্তার ভাঙন দেখেছি। গাছপালা গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি ভাঙার সময় বুক ফেটে যায়। গতবার মন্ত্রী আসলো, এমনভাবে বললো, যেনো তখনই বাঁধ হয়। চেয়ারম্যানরা মিলে টাকা তুলে, আরও অনেকের কাছে কয়েক লক্ষ টাকা এনে একটি বালির বাধ দেয়া হচ্ছে। ওই বাঁধটাও টিকলো না। নদীর পানির একটি পথ থাকে, সেটা দেয়া লাগে। নদীর ভাঙন গড়নের সাথে বুকও ভাঙে গড়ে। সবাই আমাদেরকে বুঝায়, আর লাঞ্চনা আমাদের ভোগায়।

এবার লালমনিরহাটে বর্ষা এখনও জেকে বসেনি। তারপরও তিস্তার পানি কমা-বাড়া করার কারণে ভেঙেছে তিনবার। স্থানীয়দের চাঁদায় করা ৪০ ফিট প্রস্থ, ৩৫ ফিটের একটি বিশাল বালির বাঁধ গত ১০ দিনে নদীগর্ভে চলে গেছে। ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তিস্তাপড়ের ভাঙন কবলিত মানুষরা দাবি করেছেন, তারা বারবার বাঁধ এবং ভাঙন রোধে সর্বস্তরের কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেক কামনা করেছেন। প্রতিকার মিলেনি। চোখের সামনেই সব কিছু ভাঙছে।

ইতোমধ্যে লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, বালির বাঁধটি দেয়ার সময় তাদের সায় ছিল না। স্থানীয়রা এই বাঁধটি তৈরি করেছে। এমন বাঁধ তিস্তায় টেকে না। ভাঙন কবলিত এলাকার জন্য সবরকম প্রস্তুতি আছে। ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। যেকোন সময় প্রকল্পটি পাশ হবে। প্রকল্পটি পাশ হলে কিছু কাজ করা যাবে। এছাড়াও তিস্তার যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে, ছোট ছোট প্রকল্পগুলির আর দরকার হবে না। মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে স্থায়ী সমাধান হবে।

গেলো বছর ২৬ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এবং তিস্তা ব্যারাজ পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি তিস্তার বিভিন্ন ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। নদীপাড়ের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেন। তুলে ধরেন ভাঙন রোধে সরকারের নানামুখি ভাবনা। বামতীরের ১১৩ কিলোমিটার নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথাও বলেন। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন, প্রকল্পগুলি শুরু করতে এক থেকে দের বছর সময় লাগবে।

ভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। গ্রহণ করা হয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার মহা পরিকল্পনা। ইতমধ্যে তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে দেড়হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে তিস্তার সেচ প্রকল্পগুলির কাজ করা হবে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড নিশ্চিত করেছে। রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী জেলার চাষাবাদে ১০ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন ছিল। কিন্ত চাষের সময় পানি মিলেছে মাত্র আড়াইহাজার কিউসেক। এই সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় তিস্তার পানি তেমন উপকারে আসছে না বলে জানান কৃষকরা।

তিস্তা পানির বিপৎসীমার রেকর্ড পরিবর্তিত হয়েছে ৫ বছরে তিনবার। পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাট দপ্তর রেকর্ড পরিবর্তনের হিসেব দিতে পারেনি। তবে, পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের বিভাগীয় উপ-প্রকৌশলী কৃঞ্চ কমল চন্দ্র সরকার জানান, গত ৫ বছরে তিনবার রেকর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে। ৫২.২৫, ৫২.৪০ বর্তমানে ৫২.৬০ সেন্টিমিটার করা হয়েছে। তবে বর্তমান রেকর্ড পাটগ্রামে ৫৮.৮৩০ এবং লালমনিরহাট সদর অংশে ৩১.০৯ সেন্টিমিটার। বারবার রেকর্ড পরিবর্তনই বলে, নদী দুটি কতোটা ভরাট হয়েছে।

দোয়ানী ব্যারাজ প্রকল্পের উজানে ২৫ কিলোমিটার এবং ভাটিতে ব্যারাজ থেকে তিস্তা কাউনিয়া সড়ক সেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার।

প্রতিবেদন তৈরিতে তিস্তা নদী বাম তীর রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ সরওয়ার হায়াত জানান, তিস্তা নিয়ে যে মহাপরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, তা কতোদিনে হবে তা বলা মুশকিল। তিস্তা নদী গতীপথকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব নিয়ে অনেক আন্দোলন করা হয়েছে। কাজ হয়নি। ওপর থেকে লোক এসে পরিদর্শন করছে, আশ্বাস দিচ্ছে, চলে যাচ্ছে। যদি কোনোদিন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আমূল পরিবর্তন হতে পারে এই এলাকার। কোনদিন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সাথে সাথে এখানে কৃষিজাত পণ্যের শিল্প গড়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন ফিড মিল গড়ে উঠতে পারে। তিস্তার চরে প্রতি বিঘায় ৫০ মণের বেশি ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে। মরিচ, পেঁয়াজ, মশলা জাতীয় ফসল নির্ভর এসব শিল্প গড়ে উঠলে অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। সমাধান হবে বেকার সমস্যার।

অধ্যক্ষ সরওয়ারের ঐ কমিটির একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার সহায় সম্বল ভিটে মাটি হারিয়েছে। তিস্তার ভাঙনে ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি বিলিন হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা আর পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজ করার সময় বলা হয়েছিল, ব্যারাজের দু’পাশে সিসি ব্লক ডাম্পিং করে এবং মাঝে মাঝে গ্রোয়িং নির্মাণ করে তিস্তাকে একটি নির্দিষ্ট চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত করা হবে। কিন্তু ব্যারাজের ডিজাইনার আইনুন নিশাদের স্বদিচ্ছার অভাবে তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।

বর্ষাতে গড়ে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কিউসেক পানি আসে। এই পানি লালমনিরহাট অংশ দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে নদীর নাব্যতা হারিয়েছে। নদীর প্রশস্ততা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ কিলোমিটার, যা দুই কিলোমিটার থাকার কথা। যার কারণেই মূলত বন্যা-ভাঙনের কবলে পড়তে হচ্ছে বারবার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রধান প্রকৌশলীর বরাত দিয়ে তাদের গবেষণায় দাবি করছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের ৫% খরচ করলে তিস্তা ব্যারাজ থেকে কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটারে প্রটেক্টিভ বাঁধ দেয়া যেতো।

উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে শেষ হয়। সেই সময় ব্যারেজ নির্মাণে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।

ঢাকা/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়