ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

মোজাম্মেলের এতটুকু আশা

মোসলেম উদ্দিন, দিনাজপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৭, ১৭ জুন ২০২১   আপডেট: ১৮:২৯, ২২ জুন ২০২১
মোজাম্মেলের এতটুকু আশা

মোজাম্মেল হক (৫৭) একে একে সব হারিয়েছেন। ভিটে-মাটি-জমি; এমনকি অসুস্থ হয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়েছেন দুই পা। তবুও মনোবল হারাননি। তিনি চাননি অন্যের বোঝা হতে। জীবন তার কাছ থেকে যা ছিনিয়ে নিয়েছে, তিনি চেষ্টা করেছেন মানিয়ে নিতে। এখানেই শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষটির সাফল্য।

গত ১১ জুন বিরামপুর উপজেলার কুন্দন বাজারে গিয়ে দেখে যায়, দোকানে কাজ করছেন মোজাম্মেল। হাতের উপর ভর দিয়ে চলাফেরা করছেন তিনি। কোমরের নিচের অংশ পলিথিনে বাঁধা। যদিও এই প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি মোজাম্মেলের কর্মজীবনে। সাইকেল, রিকশা, ভ্যানগাড়ি সারাইয়ের কাজ করেন তিনি; নেই কোনো সহকারী।

সপ্তাহে দু’দিন হাট বার। সেদিন মোজাম্মেলের ব্যস্ততা বাড়ে, রোজগারও হয় অন্যদিনের তুলনায় বেশি। কিন্তু সেটুকুতে সংসারের নিত্য অভাব ঘোঁচে না। একটি কুঁড়ে ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। এই বর্ষায় ঘরটি মেরামত করতে হবে- দমকা বাতাসে ঘর নড়ে। মোজাম্মেল ঘাবড়ান না। কারণ তিনি জীবন-ঝড়ে জিতে যাওয়া মানুষ। তারপরও কাজের ফাঁকে অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ে। মোজাম্মেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কি আর করার আছে? মানুষ তো!’

প্রায় ১৫ বছর আগে, মোজাম্মেল হকের ডান পায়ের এক আঙুলে ঘা হয়। এই ঘা যে জীবনের কাল হবে ভাবেননি। চিকিৎসা করিয়েছেন, সুস্থ হননি। ডাক্তারের পরামর্শে আঙুল কেটে ফেলতে হয় তার। এরপর কিছুদিন সুস্থ ছিলেন, হঠাৎ ছন্দপতন। এবার ডাক্তারের পরামর্শ- গোড়ালি থেকে নিচের অংশ কেটে ফেলতে হবে। মোজাম্মেল ধরে নিয়েছিলেন এবারের মতো হয়তো বেঁচে গেলেন। কিন্তু তখন অলক্ষ্যে বসে মুচকি হেসেছেন বিধাতা। গোড়ালি কেটে ফেলার কিছুদিন পর পায়ে আবারও পচন ধরে। এবার কাটতে হয় পায়ের অর্ধেক অংশ। এরপরও পুরোপুরি সুস্থ হননি মোজাম্মেল। এবার আসে সবচেয়ে বড় আঘাত। পচন ছড়িয়ে পড়ে কোমরের নিচ পর্যন্ত। চিকিৎসক স্পষ্ট বলে দেন- বেছে নিতে হবে যে কোনো একটি- জীবন নয়তো পা। মোজাম্মেল হক বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে সেদিন চিকিৎসকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন- ‘ডাক্তারসাব, বাঁচবো তো?’

অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসার পর মোজাম্মেল বুঝে ফেলেন তিনি সারাজীবনের জন্য প্রতিবন্ধী মানুষে পরিণত হয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ শরীর নিয়ে সুস্থ জীবনযাপনের আর কোনো পথই খোলা রাখেননি বিধাতা। কিন্তু জীবন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ মোজাম্মেলের জানা। দাঁতে দাঁত চেপে সেই পথেই হাঁটছেন তিনি।

এক সময় গ্রামবাসী মোজাম্মেল হককে ‘মেইল’ বলে ডাকতো। তার চলাফেরায় ছিল মেইল গাড়ির গতি। চটপট কাজ করতে পারতেন। নিজের কাজ শেষে অন্যদের কাজেও হাত লাগাতেন। সেই গতি এখনও মনের ভেতর টের পান মোজাম্মেল। তার দোকানে এসে গ্রাহককে অপেক্ষা করতে হয় না। তিন চাকার ভ্যানগাড়ি মেরামত করতে আসা গোলাম রসুল বলেন, ‘আমি অন্য কোথাও গাড়ি ঠিক করি না। কষ্ট করে হলেও মোজাম্মেল ভাইয়ের এখানে আসি। সমস্যার কথা বললে ভাই ঠিক বুঝে ফেলেন- কোন পার্টসে ঝামেলা হইছে!’

‘মেইল (মোজাম্মেল) ভাইয়ের পা না থাকলেও শরীরের শক্তি ঠিকই আছে। হাতের কাজ খুব মজবুত। ফলে অন্য কোথাও কাজ করাই না।’ বলেন স্থানীয় রিকশাচালক করিমউদ্দিন।

ছোট্ট গ্যারেজে বসেই কথা হয় মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। তিনি তখন শক্ত হাতে ভ্যানগাড়ির চাকার স্পোকের প্যাঁচ খুলছিলেন। সেদিকে মনোযোগ রেখেই বলেন, ‘জীবনের অবশিষ্ট এখন আর কিছু নাই। সারাদিন এই সাইকেল, রিকশা মেরামত করে যা পাই তাই দিয়ে কোনোভাবে চলে।’ কিন্তু এভাবে কতদিন? বয়স বাড়ছে। ছেলেমেয়েরা আলাদা থাকে। জীবনে কোনো স্বপ্নই কি অবশিষ্ট নেই?

প্রশ্ন করতেই হাতের কাজ থামান মোজাম্মেল। ‘যদি কিছু অর্থ পেতাম সাইকেল, ভ্যান আর রিকশার যন্ত্রপাতি কিনতাম। তাহলে গ্যারেজে আরও লোকজন আসতো। বেচাবিক্রিও বাড়তো।’ মোজাম্মেল দম নেন। পুনরায় কাজে মনোযোগ দেওয়ার আগে বলেন, ‘পুঁজি নাই। পুঁজি থাকলে দোকান বড় করতাম। তাতে যদি শেষ বেলায় একটু সুখের নাগাল পাই- এটুকুই আশা।’

এ প্রসঙ্গে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিমল সরকারের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি মোজাম্মেল হকের বিষয়ে অবগত জানিয়ে বলেন, ‘তার পঙ্গু ভাতার কার্ড আছে। তবে এর বাইরেও এ ধরনের মানুষের জন্য যদি কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা আসে তাহলে অবশ্যই তাকে দেওয়া হবে।’

হয়তো সরকারি সহায়তা মোজাম্মেল পাবেন। তাতে সুখের নাগালের খোঁজ কতটুকু মিলবে বলা কঠিন। মোজাম্মেলের ছোট্ট আশা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের বিত্তবানদের। যাতে মোজাম্মেল পুনরায় ফিরে পান মেইলের গতি।    
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়