ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁওয়ে গৃহবধূ মিলির মৃত্যু, দেহজুড়েই অমানবিকতার নানা চিহ্ন

ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৮, ১৮ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১২:২৫, ১৮ জুলাই ২০২১
ঠাকুরগাঁওয়ে গৃহবধূ মিলির মৃত্যু, দেহজুড়েই অমানবিকতার নানা চিহ্ন

ঠাকুরগাঁও শহরের শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়কের দুইটি বিপণিবিতানের মাঝের ফাঁকা সরু গলিতে পড়েছিলো গৃহবধূ সান্তনা রায় ওরফে মিলি চক্রবর্তীর (৪৯) লাশ।

এই গৃহবধূর মৃত্যু জন্ম দিয়েছে অনেক রহস্যের।  পুলিশের মামলার বর্ণনা ও সুরতহাল রিপোর্টে যা উঠে এসেছে, তার সবই ভয়াবহ।  গৃহবধূর দেহজুড়েই রয়েছে, তার সঙ্গে চরম অমানবিকতার নানা চিহ্ন।  

গৃহবধূ সান্তনা রায় ওরফে মিলি চক্রবর্তী ছিলেন ঠাকুরগাঁও শহরের তাঁতিপাড়া এলাকার সমির কুমার রায়ের স্ত্রী।

ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি তানভিরুল ইসলাম বলেন, এই গৃহবধূর লাশ উদ্ধারের দুইদিন পর গত ১০ জুলাই ঠাকুরগাঁও সদর থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) নির্মল কুমার রায় বাদী হয়ে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলার বর্ণনায় বলা হয়, গত ৮ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশের জাতীয় সেবা নম্বর ৯৯৯ থেকে জানানো হয় ঠাকুরগাঁও শহরের শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়কের দুইটি বিপণি বিতানের মাঝের ফাঁকা সরু গলিতে এক গৃহবধুর লাশ পরে রয়েছে।  খবর পেয়ে তৎক্ষণাত ঘটনাস্থলে এসে পুলিশ গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে।  পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় গৃহবধূর পরিচয় নিশ্চিত করা হয়।

এদিকে সুরতহাল রিপোর্ট করার সময় গৃহবধূর ডান হাতের কনুই থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত, বাম হাতের নিচের অংশ, দুই হাতের নখ, তালু, আঙ্গুল, পায়ের তালু, পায়ের আঙ্গুল ও বাম হাতের কবজির উপরে সুতা বাঁধা স্বাভাবিক পাওয়া যায়।  তবে মাথার চুল খোপা বাঁধা, ভ্রুর চুল, চোখের পাতা আংশিক পোড়া ছিল।  এছাড়া কোমড়ের নিচ অংশ থেকে পায়ের তালুর ওপরের অংশের বিভিন্ন জায়গায় পোড়ানো ছিল।  কপালের চামড়া, জিহবা, ঠোঁট, থুতনি, কান, গলা, বুক, পেট, তল পেট, ডান হাতের বাহু থেকে কনুই পর্যন্ত ও বাম হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত এবং যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ ঝলসানো পোড়া অবস্থায় পাওয়া যায়।

অন্যদিকে গৃহবধূর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিলো এবং জিহ্বা বাহিরে দাঁত দিয়ে কামড়ানো অবস্থায় ছিলো।  তার শরীরের বস্ত্রের ডান হাতের বাহুর জামার কিছু অংশ এবং দুই পায়ের হাঁটুর নিচে পায়জামার কিছু অংশ পোড়া অবস্থায় দেখা গেলেও পোশাকের বাকি অংশ পুড়ে ছাই হওয়া অবস্থায় পাওয়া যায়।

মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে ময়নাতদন্তের জন্য গৃহবধূর লাশ ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জনের মাধ্যমে বিভাগীয় প্রধান ফরেনসিক বিভাগ দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

মৃতদেহের আশপাশে পরে থাকা পোড়া অবস্থায় কেরোসিনের পট, দিয়াশলাই, জুতা, ভেজাইনাল সোয়াব, ভিকটিমের রক্তের সোয়াব, ভিকটিমের বাক্কাল সোয়াব, ভিকটিমের শরীরের ঘামের সোয়াব ও আনুষাঙ্গিক দ্রব্যাদি ক্রাইমসিন টিম সিআইডি’র মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় এবং সেগুলো জব্দ করা হয়।

মামলায় বলা হয়, মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্য মামলার বাদী ওই গৃহবধূর স্বামী, ছেলে, ভাইসহ আত্মীয় স্বজন ও এলাকার লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং ঘটনাস্থলের স্থিরচিত্র ক্যামেরায় ধারণ করেন।  এছাড়াও গোপনে ও প্রকাশ্যে বিষয়টি তিনি ব্যাপকভাবে তদন্ত করেন।

প্রাথমিক তদন্তের জিজ্ঞাসাবাদে মৃত গৃহবধূর স্বামী ও তার ছেলে জানায়, গত ৭ জুলাই রাত ১০টার দিকে খাওয়া শেষ করে বাড়ির লোকজন ঘুড়িয়ে পড়ে।  পরদিন ৮ জুলাই সকাল ৮ টার দিকে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির লোকজন জানতে পারেন- তার মরদেহ তাঁতিপাড়াস্থ বাটা শোরুম এবং নির্মাণাধীন ভবনের মাঝে সরু গলিতে পড়ে আছে।

মামলায় আরও বলা হয়, গৃহবধূকে কে বা কাহারা হত্যা করে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য তার মরদেহ তাঁতিপাড়াস্থ বাটা শোরুম এবং নির্মাণাধীন ভবনের মাঝে সরু গলিতে ফেলে রাখে এবং প্রাথমিকভাবে এমন তথ্য পাওয়ার পর মৃতের আত্মীয় স্বজনদেরকে অভিযোগ দেওয়ার জন্য বলা হয়।  কিন্তু তারা অভিযোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

তবে ঘটনার দিন অর্থাৎ ৮ জুলাই নিহতের স্বামী সমীর কুমার রায় বলেছিলেন, রাতে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ি।  সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মিলি বিছানায় নেই।  পরে খোঁজাখুঁজির পর বাড়ির পাশের গলিতে তার লাশ দেখতে পাই।  কিভাবে এমনটা হলো কিছুই বলতে পারছি না।  তবে তিনি দাবি করে বলেন, মিলি চক্রবর্তী দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছিলেন।

স্থানীয়রা জানান, এই গৃহবধূ খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন, তিনি স্বাভাবিক ছিলেন।  কখনো তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করেননি।  

মামলার বাদী সদর থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) নির্মল কুমার রায় বলেন, গৃহবধু সান্তনা রায় ওরফে মিলি চক্রবর্তীর লাশ উদ্ধারের পর ঘটনাটি আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। মনে হয়েছে কে বা কাহারা তাকে হত্যা করেছে এবং ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য লাশ ঐ দুই বিপণিবিতানের মাঝখানের সরু গলিতে ফেলে রেখেছে।  তাই সত্য ঘটনা উদঘাটনের জন্যই মামলাটি করেছি।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি তানভিরুল ইসলাম বলেন, গৃহবধু সান্তনা রায় ওরফে মিলি চক্রবর্তীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে আমরা কাজ করছি।  ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এখনো আমরা পাইনি, সেটি পেলে অনেকগুলো বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে।  আশা করি খুব অল্প সময়ের মধ্যে মিলির মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন হবে।

হিমেল/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়