ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নদীতে বিলীন বসতবাড়ি, চোখের পানিতে ঈদ

শাহীন আনোয়ার  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৫, ২১ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৫:৪৪, ২১ জুলাই ২০২১
নদীতে বিলীন বসতবাড়ি, চোখের পানিতে ঈদ

বিধবা নারী সামেলা বেগম (৫০)। স্বামী মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। পাঁচ মেয়ের মধ্যে দুই জন প্রতিবন্ধী। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের কাশিপুর গ্রামে মধুমতি নদীর পাড়ে বাস করেন।

বসত ঘরের দুই হাত দূরে মধুমতি নদী ফুঁসছে। যেকোন সময় শেষ সম্বল বসত ঘরটি মধুমতির পেটে চলে যেতে পারে। ঘরের মালপত্র প্রতিবেশীর ঘরে রেখে তাদের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। ঈদের দিন চুলো জ্বলেনি। পাশের বাড়ির পাঠানো খাবার খেয়েছেন।

সামেলা বেগম বলেন, ‘বাইচা যে আছি এটাই তো অনেক, ঈদ কী করব? নদী আমাগের সব কাড়ে নেছে । এটটু ঘর ছিল তাও যাওয়ার পথে। শরীকরা সব চলে গেছে-আমার যাওয়ার কোনো জাগা নাই। এতোডিক মায়ে (এতগুলো মেয়ে) নিয়ে কহানে যাব কী করব কিছুই বুঝতেছি নে।’

শুধু সামেলা বেগম নয়, উপজেলা সদর ইউনিয়নের মধুমতি পাড়ের ভাঙন কবলিত কাশিপুর, রুইজানি ও ভোলানাথপুর গ্রামের হাজারো মানুষের মনে কোনো ঈদের আনন্দ নাই।

গত দশ দিনে দুই শতাধিক বসত ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী গিলে খেয়েছে কয়েকশ’ বিঘা ফসলি জমি। হুমকির মুখে পড়েছে বহু বসতবাড়ি ঘর, স্কুল, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, হাট-বাজার, গোরস্থান ও মন্দিরসহ শহর রক্ষা বাঁধ।

আজ বুধবার (২১ জুলাই) ঈদুল আজহার দিন সকালে উপজেলা সদরের মধুমতি পাড়ের কাশিপুর, ভোলানাথপুর ও রুইজানি গ্রাম ঘুরে ভাঙন কবলিত মানুষের করুণ চিত্র দেখা গেছে। এক মাসেরও বেশি সময় আগে তিন গ্রামে নদীভাঙন দেখা দেয়।

গত দশ দিন ধরে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। এই সময়ের মধ্যে গ্রামগুলোর প্রায় দুই’শ পরিবারের হাজারো মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। তারা অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে অথবা খোলা জায়গায় ছাউনি করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের ঈদ বলে কিছু নাই। বেঁচে থাকার সংগ্রামই তাদের সবকিছু।

কাশিপুর গ্রামের জয়েনউদ্দিন মোল্যা দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালান। বসতভিটাটুকুই ছিল তার একমাত্র সম্বল। গত রোববার দুপুরের দিকে নদী ভাঙনে চোখের সামনেই তার সম্বলটুকু মধুমুতিতে বিলীন হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে এ সময় চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তার।

ভাঙনের দুদিন আগেই জয়েন উদ্দিন আশ্রয় নেন নিজ গ্রামের পরিচিত একজনের বাড়িতে। কিন্তু এ আশ্রয়টিও দু-এক দিনের মধ্যে নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এরপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথায় ঠাঁই
নেবেন তা নিয়ে কোন কূল পাচ্ছেন না। 

আজ ঈদ। কিন্তু তা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই তার। আক্ষেপ করে জয়েন উদ্দিন বলেন, ‘বাড়িখান গাঙে নিয়ে গেল। ভাঙনের চিন্তায় কয়েক দিন কাজ-কামে না যাওয়ায় ঘরে চাইল-ডাইল নাই। প্যাটে ভাত নাই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই তাগরে আবার কিসের ঈদ ?’

জয়েন উদ্দিনের মতো অবস্থা গত দশ দিনে নদী ভাঙনে নিঃস্ব হওয়া তিন গ্রামের হাজার খানেক মানুষের। খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটছে তাদের। তাই তাদের মনে ঈদের আনন্দ নেই। অথচ গত বছর ঈদেও অনেক আনন্দ করেছেন তাঁরা।

কাশিপুর গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারুল হক, মোল্যা, রাবেয়া বেগম, বাচ্চু মিয় (৪০), মতিয়ার রহমান (৬০), মিজানুর রহমান মোল্যা (৫০) এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গত বছর ঈদে বাড়ির সবাই নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের আনন্দ করছি। অথচ এবারের ঈদ যাচ্ছে চোখের পানিতে।’

রুইজানি গ্রামের জাহাঙ্গীর মোল্যা (৭০) ও আসাদ মোল্যা (৬০) বলেন, নদী আমাদেও সব শেষ করে দিলো। এবার ঈদটাও করতে পারলাম না। এখন বসত বাড়ি অন্যত্র সরানোর চিন্তায় ব্যস্ত।  

ভোলানাথপুর গ্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মিলন বলে, ‘বাড়ি ভাঙ্গে যাওয়ায় আমরা আরও অসহায় হয়ে গেছি। তাই এবারের ঈদে আব্বা আমারে নতুন জামা দিতি পারে নাই।’

মিলনের মা ফরিদা বেগম কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন, ‘আমাগের খাওয়া-দাওয়াই ঠিকমতো হচ্ছে না। ছাওয়াল-মেয়ের ঈদের জামা দেব কেম মায়ে ?’

মধুমতি পাড়ের বাসিন্দা বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. তিলাম হোসেন বলেন, নদী পাড়ে ঈদ দেই। মধুমতির ভাঙন এবার বর্ষা আসার আগেই তীব্র আকার ধারন করেছে। শহীদ আবির হোসেনের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তার কবরস্থানও হুমকির মুখে।

বসুরধুলজুড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মধুমতি নদী এখন দুইশ গজ দূরে অবস্থান করছে। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রিয়াজুর রহমান বলেন, ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে নদীতে বিলীন হয়ে যাবে বহু বসত বাড়ি ঘর, স্কুল, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, হাট-বাজার, গোরস্থান ও মন্দিরসহ শহর রক্ষা বাঁধ।

মহম্মদপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাবেয়া বেগম  বলেন, ‘ভাঙন-দুর্গতরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের জন্য এখন পর্যন্ত একবার সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’

মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কমর্তা (ইউএনও) রামানন্দ পাল বলেন, ভাঙন-দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে খাবার সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাওবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সরোয়ার জাহান সুজন জানান, ভাঙন এলাকা ঘুরে এসছেন তিনি। ভাঙন প্রতিরোধে প্রাথমিকভাবে জিও ব্যাগ (বালুর বস্তা) ফেলার কাজ শুরু হবে শিগগিরই।

মাগুরা/শাহীন/এমএম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়