ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নিজের খোঁড়া গর্তে ১৫ বছর ধরে শিকলবন্দি রবিউল

শাহীন আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২০, ৩১ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৯:১৭, ৩১ জুলাই ২০২১

মানসিক ভারসাম‌্য হারিয়ে ফেলার পর শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো মো. রবিউল ইসলাম মোল্যাকে। এ অবস্থায় কেটে গেছে ১৫টি বছর। বন্দি থাকা অবস্থায় ঘরের মেঝেতে গর্ত খোঁড়া শুরু করে সে। খালি হাতে খুঁড়তে খুঁড়তে সেই গর্ত এখন ছোটখাটো একটি পুকুর হয়ে গেছে। সেই গর্তেই বসবাস রবিউলের। সেখানেই খাওয়া, সেখানেই ঘুম। এভাবেই চলছে।

ভারসাম‌্য হারানোর পর মা আসমানি বেগম (৫০) ছাড়া আর কাউকে সহ‌্য করতে পারে না রবিউল। কেউ কাছে গেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাই মা-ই দেখভাল করেন ছেলেকে। মানসিক ভারসাম‌্যহীন হলেও রবিউল তার বড় ছেলে। অনেক আদরের, ভালোবাসার। তাই ছেলেকে নাওয়ানো, খাওয়ানোর সব কাজ মা-ই করছেন।

শ্রবণপ্রতিবন্ধী মা আসমানী বেগম বলেন, ‘‘শৈশবে অন্য আর দশটি শিশুর মতো সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল রবিউল। খেলাধূলা, নদীতে সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানোয় তার মতো পারদর্শী আর কেউ ছিল না গ্রামে। ৯ বছর বয়সে এক জ্বর রবিউলের জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। 

‘ধীরে ধীরে হাত-পা শুকিয়ে যেতে থাকে রবিউলের। মুখের কথা হারিয়ে যায়। সাধ্যমতো চিকিৎসা করানো হয়েছে। তবু ছেলেটি আর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই চূড়ান্তভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।”

তিনি আরও বলেন, ‘একপর্যায়ে ছেলের আচরণ হয়ে পড়ে উন্মাদের মতো। যাকেতাকে মারধর করা, জিনিসপত্র ভাঙচুর করা শুরু করে। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়। এভাবে কেটে গেছে ১৫ বছর। শীত বা গরম কোনো অনুভূতিই টের পায় না রবিউল। শরীরে কোনো কাপড়ও রাখে না।’

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের পশ্চিম চরবর্ণি গ্রামের মো. নুরুল মোল্লার (৫৫) ছেলে রবিউল। নুরুল মোল্লা এখন ভ্যান চালান। আগে তার অবস্থা বেশ ভালো ছিল। জমি-জমা, দোকান সবই ছিল। এখন নিঃস্ব। তার তিন ছেলের মধ্যে রবিউল সবার বড়। মেজ ছেলের নাম ইমরান মোল্লা (৩০), ছোটটি এনামুল মোল্লা (২৫)।

রবিউলের বাবা মো. নূরুল মোল্লা বলেন, ‘শিকল খুলে দিলে রবিউল ভাঙচুর করে। হারিয়ে যায়। মনে না মানলেও বাধ্য হয়ে ছেলেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হচ্ছে। ছেলেটিকে সুস্থ করতে বহু চেষ্টা করেছি। ওর ওজনের সমান টাকা খরচ করেছি। ভালো করতে পারিনি। দোকান-ব্যবসা-জায়গা-জমি সব ওর চিকিৎসার পেছনে শেষ। এখন ভ্যান চালিয়ে খাই। ওর আর সুস্থ হওয়ার আশা নেই। কোনো বাপ-মা সন্তানকে শিকলে বেঁধে রাখতে চায় না।’

রবিউলের মেঝ ভাই ইমরান মোল্লার স্ত্রী রহিমা খাতুন জানান, তার শ্বশুরের জায়গা-জমি ও সাংসারিক অবস্থা আগে ভালো ছিল। বড় ভাইয়ের চিকিৎসায় সব শেষ। এখন ভ‌্যান চালান। তার স্বামীও এখন ভ্যান চালান। এভাবেই চলছে।

ছোট ভাই এনামুল মোল্যা জানান, ছোটবেলায় বড় ভাই রবিউল তাকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলেন। তাকে খুব আদর করতেন। বড় ভাই এখন মানসিক ভারসাম‌্যহীন। ভাইয়ের জন‌্য খারাপ লাগে। তবু কিছু করার নেই।

স্থানীয় ময়না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির মো. সেলিম বলেন, ‘রবিউলের বিষয়টি জানা আছে। সে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে। তার চিকিৎসার বিষয়েও আলোচনা চলছে।’

বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ বলেন, ‘রবিউলের খবরটি জানার পর তার বাড়িতে দুবার গিয়েছি। তাৎক্ষণিক অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। তার চিকিৎসার বিষয়ে উদ‌্যোগ নেওয়া হবে।’

মাগুরা/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়